
ঝালকাঠি: জাহাজের ভগ্নাংশ। -ছবি মুক্ত প্রভাত
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধার কাজে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উদ্ধারকারীরা উদ্ধার কাজ বন্ধ রেখে জাহাজের তেল সরানো নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এঘটনায় ৪ সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পদ্মা কোম্পানী ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুর রহমান মুক্ত প্রভাতকে জানান, অবহেলার ঘটনা তদন্তে কোম্পানীর অপারেশন ম্যানেজারকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
শনিবার থেকে তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এই সংবাদ লেখা পর্যন্ত এক জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, নদীতে পড়ে থাকা জাহাজের ভগ্নাংশ উদ্ধারে বিআইডব্লিউটিএ জাহাজ হামজাকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছে।
নিখোঁজের স্বজনেরা দুর্ঘটনা কবলিত সাগর নন্দিনী জাহাজের মালিক পক্ষ এবং পদ্মা কোম্পানীর বিরুদ্ধে উদ্ধার অভিযান বন্ধ রেখে তেল সরিয়ে নেয়ার কাজে ব্যাস্ত থাকার অভিযোগ করেছেন।
এদিকে বিস্ফোরণে বিচ্ছিন্ন জাহাজের পিছন অংশের সন্ধান পাওয়া গেছে নদীর ভিতরে। তবে কোস্টগার্ড এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে— পানির ভিতরে সন্ধান পাওয়া জাহাজের ঐ অংশের ভিতরে প্রবেশ করা যাচ্ছেনা। তাই উদ্ধার অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। স্বজনদের ধারণা্ বিস্ফোরণের সময় যারা বেড়িয়ে যেতে পারেননি তাদের মৃতদেহ ঐ অংশের নিচে চাপা পরে আছে।
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিখোঁজ ৪ জনের পরিচয় মিলেছে। ঘটনার পরদিন রবিবার নিখোঁজের স্বজনরা ঘটনাস্থলে এসে কোন সন্ধান না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
তাদের অভিযোগ— জাহাজ কর্তৃপক্ষের উদ্ধার অভিযানে কোন তৎপরতা নেই। নিখোঁজদের উদ্ধার অভিযানের চেষ্টা করা হচ্ছেনা। বরং কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে রক্ষায় জাহাজের তেল সরিয়ে নিতে ব্যাস্ত আছে।
নিখোঁজ যাদের পিরচয় মিলেছেঃ জাহাজের নিখোঁজ কর্মচারীদের মধ্যে যাদের পরিচয় মিলেছে তারা হলো, চাঁদপুর জেলার সুপার ভাইজার মাসুদুর রহমান বেলাল, বাখেরগঞ্জের নলুয়া ইউনিয়নের মাস্টার রুহুল আমিন খান (৪৫), পিরোজপুরের বুড়ির চর গ্রামের ড্রাইভার আকরাম হোসেন সরোয়ার (৪৫), বরিশাল বাখেরগঞ্জের পাদরী শিবপুর গ্রামের রিফাত হোসেন (১৯)।
আহতদের পরিচয়— এছাড়া আহতরা হচ্ছে, পাবনা জেলা মোদাচ্ছেরের ছেলে শাকিল (৩৫), চাঁদপুরের মৃত আবুল হোসেন পাটোয়ারীর ছেলে ফরিদুল আলম (৩৫), পিরোজপুর মঠবাড়িয়ার ছালাম বেপারীর ছেলে ইকবাল হোসেন (২৭), এই জাহাজে মোট ১৩ জন স্টাফের মধ্যে ৩ জন আগেই ছুটিতে ছিলেন। অপর ১০ জনের মধ্যে ৪ জন নিখোঁজ, ৪ জন দগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত এবং ১ জন বাবুর্চী বেলায়েত হোসেন পুলিশের তত্বাবধানে চিকিৎসায় আছে বলে জানাযায়।
ঝালকাঠি: সাগর নন্দিনী-২ জাহাজের ভগ্নাংশ। -ছবি মুক্ত প্রভাত
ঘটনা স্থলে স্বজনদের ক্ষোভ ও দাবী— রবিবার সকাল ১০ টায় ঘটনাস্থলে থাকা সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে গিয়ে দেখা যায় নিখোঁজদের না পেয়ে স্বজনরা আহাজারী এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তখন পদ্মা অয়েল কোম্পানীর খুলনার এমডি মাসুদুর রহমান, সাগর নন্দিনী-২ জাহাজ কোম্পানীর নির্বাহী পরিচালক মাহাতাবুর রহমান তেল উদ্ধারকারী জাহাজ সেভেন সিমাক-২ এর একটি এসি রুমে বসে আরাম আয়েশ ও নাস্তা করতে ব্যাস্ত। এসময় ঐ রুমের সামনে থাকা নিখোঁজদের স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিকৃয়া ব্যাক্ত করেন।
নিখোঁজ মাস্টার রুহুল আমিনের ভাই আব্দুর রহমান, নিখোঁজ সুপার ভাইজার মাসুদুর রহমানের ভাই আলাউদ্দিন, নিখোঁজ ড্রাইভার আকরাম হোসেনের ভাই মাসুম বিল্লাহ্, নিখোঁজ গ্রীজার ম্যান আব্দুস সালামের মামা শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ঘটনার পর খবর পেয়ে এখানে এসে ২ দিন অপেক্ষা করছি। কিন্তু জাহাজ মালিকের কোন প্রতিনিধির এখানে এসে নিখোঁজদের উদ্ধারে কোন তৎপরতা বা চেস্টা আমাদের চোখেঁ পরেনি।
ডিপো কর্তৃপক্ষ মালিক পক্ষের সাথে যোগাযোগ করে তাদের দূর্ঘটনা কবলিত জাহাজ থেকে তেল সরিয়ে নিতে ব্যাস্ত রয়েছে। এখন তারা এসে এসি রুমের মধ্যে আরাম আয়েশ করছে। দ্রুত ডুবুরির মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে আমরা আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবী জানাচ্ছি। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, জাহাজ কর্তৃপক্ষের আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দিতে হবে। গত শনিবার থেকে আমরা এখানে না খেয়ে বসে আছি। এখন পর্যন্ত কোন উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়নি।
উদ্ধার কাজ বন্ধ দাবী করে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রবিবার ২ জন ডুবুরী এনে ৫ মিনিটের জন্য পানিতে নামিয়ে আবার তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ মালিক কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘটনার পর নিখোঁজ স্টাফরা দূর্ঘটনার কথা আমাদের না জানিয়ে তারা পালিয়ে গেছে। এটা সম্পূর্ন অসত্য দাবী করে স্বজনরা বলেন নিখোঁজদের জীবিত অথবা মৃত ফিরিয়ে দিতে হবে।
দূর্ঘটনা কবলিত জাহাজের তেল অপসারণের প্রক্রিয়া— এদিকে পদ্মা ডিপো কর্তৃপক্ষ জাহাজ মৃদুলা-৫ এবং সেভেন সিমাক-২ এর মাধ্যমে বিস্ফোরিত জাহাজটির তেল সরিয়ে নিচ্ছে।
জানাযায়, সাগর নন্দিনী জাহাজের পুরো তেল এই জাহাজ দুটির মাধ্যমে অপসারন করে পদ্মার ডিপোতে স্থানান্তর করা হবে। সুত্র জানায়, রবিবার সন্ধার মধ্যে জাহাজ থেকে উল্লেখিত ২ টি জাহাজে ডিজেল স্থানান্তরের কাজ শেষে হবে।
এরপর সাগর নন্দিনী কোম্পানীর আরো একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে এসে পেট্রোল স্থানান্তর করে ডিপোতে সরিয়ে নেয়া হবে। এর মধ্যে ৬ লাখ ৭৬ হাজার লিটার ডিজেল অপর জাহাজে স্তানান্তরের কাজ শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও বাকি ৪ লাখ ৫ হাজার লিটার পেট্রোল সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের ভোলা দক্ষীন জোনের লেঃ শাফায়াত জানান, জাহাজটির এই দূর্ঘটনা স্থলে জেলা প্রশাসন, আমরা, ফায়ার সার্ভিস ইউনিট সমন্বয় করে কাজ করছি। ইতি মধ্যেই পিছনে বিস্ফোরনে জাহাজের নদীর ভিতরে সন্ধান পাওয়া গেছে। ঐ অংশের নিচে কোন মৃতদেহ আছে কিনা তা দেখা সম্ভব হয়নি। নদীতে অতিরিক্ত স্রোতের কারণে আমাদের ডুবুরীদল তার ভিতরে প্রবেশ করতে না পারায় চেস্টা অব্যাহত আছে।
ঝালকাঠি ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, আমাদের ডুবুরী দল নদীর পানিতে জাহাজের ভাঙ্গা অংশের ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই এর নিচে কোন মৃতদেহ আছে কিনা তা জানাযায়নি। রবিবার ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে জাহাজের ইঞ্জিন রুমের ভিতর থেকে গ্রীজার ম্যান আব্দুস সালাম হৃদয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
পদ্মা অয়েল কোম্পানীর ব্যাস্থাপনা পারিচালক মাসুদুর রহমান জানান, এই ঘটনায় ৪ সদস্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার দাবী বিস্ফোরীত জাহাজের মালিক পক্ষ ঘটনার পর থেকেই সার্বিক সহযোগীতা করছে। উদ্ধার কাজ অব্যাহত আছে।
প্রাথমিক ভাবে তিনি এই দূর্ঘটার কারন সম্পর্কে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট ছাড়া বলা যাবেনা। ইতিপূর্বে একই স্থানে সাগর নন্দিনী-৩ এ অনুরুপ দূর্ঘটার তদন্ত রিপোর্টে কি কারন পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তিনি এবষিয়ে কিছু বলবেন না বলে জানান।
ঝালকাঠি পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানান, সর্বশেষ জাহাজের ইঞ্জিন রুম থেকে যে মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাকে সনাক্ত করেছে জাহাজের বাবুর্চী বেলায়েত হোসেন।
দূর্ঘটনার পর আহত বাবুর্চী বেলায়েতকে পুলিশের সহায়তায় চিকিৎসা করে তাকে নিখোঁজ ব্যাক্তিদের মৃতদেহ সনাক্তের জন্য রাখা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতদের স্বজনরা কোন অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে ব্যাবস্থা নেব।
উল্লেখ্য, ৬ মাস আগে সাগর নন্দিনী-২ নামের এই জাহাজটি ভোলায় নদীতে নিমজ্জিত হয়। এরপর জাহাজটি উদ্ধার করে সংস্কারের পর ঝালকাঠিতে জালানী নিয়ে পাঠানো হলে আবার সুগন্ধা নদীতে এই দূর্ঘটনায় পতিত হয়।
এর আগে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে একই কোম্পানীর সাগর নন্দিনী-৩ তেলবাহী জাহাজে একই ভাবে দূর্ঘটনায় ৭ জনের প্রান হানীর ঘটনা ঘটে। যার তদন্ত রিপোর্ট আজপর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এই কোম্পানীর মালিক গোপালগঞ্জ জেলার ব্যাবসায়ী শেখ মোঃ হাফিজ।