
—ছবি মুক্ত প্রভাত
দেশের ক্রমবর্ধমান পানি সংকট নিরসনে টেকসই সমাধান হলো “ওয়াটার গ্রিড” ব্যবস্থা। বিদ্যুতের মতো জাতীয়ভাবে ওয়াটার গ্রিড গড়ে তুলতে পারলে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে উপকূলীয় নগর পর্যন্ত পানির ন্যায্য বণ্টন সম্ভব হবে।
ভৌগলিকভাবে চট্টগ্রাম শিল্প ও বন্দর নগরী হলেও জেলার একটি বড় অংশ উপকুলীয় ও পাহাড়ী এলাকা। পানি মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম হলেও জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রৃকতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করার কারণে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির কবলে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও লবণাক্ততার বিস্তার স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাকে অস্থির করে তুলেছে।
বিশেষ করে নারীরা এই সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয় তাদের। এতে তাদের সময় ও শ্রম অপচয় হয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে, সংসারে সময় দেয়া, সংসারের কাজে সময় দেয়া, শিশুদের যত্ন নেওয়া ও জীবিকার কাজে অংশ নেওয়া কমে যায়।
এছাড়া লবনাক্ততার কারণে প্রজনণ স্বাস্থ্যসহ নানা জঠিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাড়ছে নারী নির্যাতনসহ নানা অপরাধের মাত্রাও। চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির মুল উৎস কর্নফুলী ও হালদা নদী হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বন উজাড় করে ফেলায় পানির প্রাপ্যতা কমছে। যার ফলে কর্নফুলীতে পানি কমে যাচ্ছে। আবার কর্নফুলী দখল, ভরাট ও ধ্বংস করার কারণে কর্নফুলী মরে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম নগরীতে পানির জন্য হাহাকার হলেও বর্ষাকালে পুরো নগরীর থলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকারে দেখা দেয়। আবার অনেক প্রকল্প জলবায়ুর পরিবর্তন জনিত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না নেবার কারণে টেকসই হচ্ছে না। তাই জলবায়ু সহিঞ্চু টেকসই প্রকল্প প্রণয়ন ও স্থানীয় জনগোষ্টির চাহিদাকে মাথায় রেখে প্রকল্প গ্রহন করতে হবে। ২৬ আগষ্ট বিশ্ব পানি সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে চট্টগ্রামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তারা এমন মত দেন।
২৬ আগস্ট মঙ্গলবার খালি কলসি হাতে মিছিল ও মানববন্ধনের পর ওয়াসা কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত হয় “যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা—জলবায়ু সংকট মোকাবেলার হাতিয়ার” শীর্ষক মতবিনিময় সভা। আয়োজকরা জানান, কর্ণফুলী নদী দখল, ভরাট ও বন উজাড়ের কারণে পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে লবণাক্ততা, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির প্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে পানি ব্যবস্থাপনায় একটি জাতীয় কৌশল হিসেবে ওয়াটার গ্রিড অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, “কাপ্তাই লেক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সে ভরাট লেককে ড্রেজিং করবে? আমরা এ বিষয়ে অনেকবার বলেছি, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ হয়নি। কাপ্তাই লেককে আমাদের বাঁচাতেই হবে, নইলে পানি সংকট আরও প্রকট হবে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের মূল উৎস এখন কর্ণফুলী নদী, কিন্তু লবণাক্ততা একটি বড় সমস্যা। মেঘনা নদী থেকে পানি আনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু খরচ অনেক বেশি—প্রতি কিউবিক মিটারে প্রায় ১৫০ টাকা। আবার সেই পানি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে সরবরাহ করলে ব্যয় আরও বাড়ে। নির্দিষ্ট এলাকায় পানি আনলে খরচ বেশি হলেও, যদি জাতীয় পর্যায়ে ওয়াটার গ্রিড করা যায় তাহলে খরচ অনেকটাই কমে যাবে। ওয়াটার গ্রিড বাস্তবায়িত হলে সারাদেশের পানি সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ারা বেগম বলেন, “আমাদের পতেঙ্গায় জলরাশি আছে, কিন্তু সেই পানি আমরা নিতে পারছি না। চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্ব শুধু সুপেয় পানি সরবরাহ করা। ১৯৮৬ সালে একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দিয়ে শুরু হলেও এখন চারটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি, তাই প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে।” তিনি বলেন, “প্রতি ঘর বা ভবনে প্রাকৃতিক উপায়ে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনে সিডিএ থেকে ভবন নির্মাণের সময় এটিকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেই পানি আবার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সরবরাহে কাজে লাগানো যাবে। একই সঙ্গে আমরা যে জলধারাগুলো ধ্বংস করছি, সেগুলো রক্ষা করতে হবে এবং মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।”
সভায় সভাপতিত্ব করেন ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আইএসডিই বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম নাজের হোসাইন। প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের স্থানীয় সরকার পরিচালক ও ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ারা বেগম। বিশেষ অতিথি ছিলেন সরকারের যুগ্ম সচিব ও ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন) মুহম্মদ আশরাফ হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রকৌশল) বিষ্ণু কুমার সরকার ও প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দ্য ডেইলি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডস-এর ব্যুরো চিফ শামসুদ্দিন ইলিয়াছ। আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক ড. খালেদ মিজবাহউজ্জমান, পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী এবং দৈনিক দেশ রূপান্তরের ব্যুরো প্রধান ভুইয়া নজরুল, ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ক্যাব মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু। আলোচনায় অংশনেন চট্টগ্রাম সিটিকরপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর জেসমিনা খানম, অপকার নির্বাহী পরিচালক মোঃ আলমগীর, যুব ক্যাব চট্টগ্রামের সভাপতি আবু হানিফ নোমান, ক্যাব নেতা জান্নাতুল ফেরদৌস, যুব ক্যাব সদস্য আমজাদুল ইসলাম আয়াজ প্রমুখ।
আইএসডিই বাংলাদেশের আয়োজনে, পানি অধিকার প্রচারাভিযান, প্রাণ ও অ্যাকশনএইডের সহায়তায় এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
বক্তারা বলেন, পানির সংকট কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, এটি মানবাধিকারেরও প্রশ্ন। তাই এখনই ওয়াটার গ্রিড বাস্তবায়ন, কাপ্তাই লেক রক্ষা ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্ব পানি সপ্তাহ উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো “Water for Climate Action” । এ উপলক্ষে খালি কলসি হাতে নারীদের মানববন্ধন ও মিছিল অনুষ্টিত হয়। তাই পানি সংকট শুধু একটি পরিবেশগত বা প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, বরং এটি একটি মানবাধিকার ইস্যু। বিশ্ব পানি সপ্তাহ ২০২৫-এ বাংলাদেশের উপকূল থেকে উঠে আসা এই দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট বার্তা দিল— “পানি নেই, জীবন নেই। পানি সংকট সমাধানে এখনই পদক্ষেপ নিন।”