
—ছবি মুক্ত প্রভাত
বিনাহালের আবাদ রসুন। কাদায় চাষ হওয়ায় মসলা জাতীয় এই শষ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত ব্যয়, শ্রম তুলনামূলক কম। অব্যহত বাম্পার ফলন আর ভালো দামে চলনবিলের কৃষকের ভাগ্য ফিরিছে এই আবাদ। তাই সময়ের সাথে সাথে এই ফসল চলনবিলের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত।
এ অঞ্চলের কৃষকরা বলছেন— রসুন এখন কৃষকদের কাছে প্রধান অর্থকারী ফসলে রূপ নিয়েছে। গত কয়েক যুগে অন্যান্য ফসলের তুলনায় রসুন চাষ অধিক জনপ্রিয় হয়েছে। আমন ধান কাটার পর একই জমিতে কাদার ওপর রসুন রোপন করায় সেচ, সার-কীটনাশকের ব্যবহার কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এতে করে উচ্চ ফলন, অকার, অধিক পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এই রসুনের বাণিজ্যিক চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুখ্যাতি ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারেও। তাই বিনাহালে কাদায় রোপন করা ঔষুধিগুণ সমৃদ্ধ এই রসুনকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির দাবি এ অঞ্চলের মানুষের।
রাজশাহী ও বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, গেল মওসুমে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় ২৮ হাজার ১৮৫ ও বগুড়া অঞ্চলের চার জেলায় ১১ হাজার ৪১৯ হেক্টর জমিতে রসুন রোপন করা হয়েছিল। এরমধ্যে রাজশাহীতে ৫ হাজার ৫২০, নওগাঁয় ৭৬৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩ হাজার ৭০০, নাটোরে ১৮ হাজার ২০০, বগুড়ায় ৬০০, জয়পুরহাটে ২৮৭, পাবনায় ৯ হাজার ৬৩২, সিরাজগঞ্জে ৯০০ হেক্টর জমিতে রসুনের আবাদ হয়েছিল।
হিসেব বলছে, রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চলে ২০২১ মওসুমে ৫১ হাজার ৪৩৩ হেক্টর, ২২ মওসুমে ৪৪ হাজার ৪৬৯, হেক্টর, ২৩ মওসুমে ৩৭ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে বিনাহালে রসুন আবাদ করা হয়। এই ৩ মওসুমে রসুনের উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭০৭ মেট্রিকটন। আগামী মওসুমে রসুনের আবাদ উৎপাদন আরো বৃদ্ধির আশা করছে কৃষি বিভাগ।
সার-কীটনাশক ব্যতিত চাষ পদ্ধতি
প্রবীণ কৃষক মহররম আলী, আকুল মিয়া ও সুখ চন্দন জানালেন, চলনবিলে রসুনের আবাদ শতবছরের পুড়নো। এক সময় হাল চাষের মাধ্যমে সার-কীটনাশকের ব্যবহার করে জমি প্রস্তুতের পর রসুন আবাদ করা হতো। রোপনের পর পরই এতে সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো। সেচ সংকট, কৃষকের আর্থিক দৈন্যতায় পরিচর্যায় ঘাটতিসহ নানা কারণে ফলনও কম হতো। বানের পানি নামার পর বিনাহালে কাদায় রসুন রোপন শুরুর পর থেকে হালচাষের রসুন বিলুপ্ত হয়েছে।
কৃষক ছুলাইমান মৃধা বলেন, কাদার ওপর রসুন রোপনের জন্য আলাদা করে জমি প্রস্তুত করতে হয়না। চলনবিলের উন্মুক্তজলাশি আবাদি জমিতে পলি রেখে যাওয়ায় জমির উর্বরতা বেড়ে যায় বহুগুণে। ফলে অতিরিক্ত বালাই নাশক ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। ধান কাটার পর পানি নেমে গেলে কাদার ওপর রসুনের কোয়া পুতে দেওয়া হয়। ধানের খর বা কচুড়িপানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় রোপন করা রসুন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই রসুনের চারা গজায়। রোধ বৃষ্টিতে ঢেকে দেওয়া আবরণ ধানের খড়, কচুড়িপানা ধীরে ধীরে পচে যাওয়ায় প্রচুর পরিমাণে জৌব শক্তি পায় এই ফসল। ফলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত রসুন অব্যহতভাবে ভালো ফলন দেয়।
জনপ্রিয় এই ফসল এখন ‘সাদা সোনা’ খ্যাত
সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত সাদা ঝকঝকে রসুনের গুণতমান যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি স্বাদ-গন্ধ আর ঝাঁজের দিক থেকেও অতুলনীয়। কৃষকদের ভাষ্যমতে, প্রতি বিঘায় ৪৫ হাজার টাকা ব্যায়ে গড়ে ২২ থেকে ২৫ মণহারে রসুনের ফলন পাওয়া গেছে। বাজার দর ভালো থাকায় আর্থিকভাবে লাভবানও হয়েছেন কৃষক। আবার একই সঙ্গে একই খরচে রসুনের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে তরমুজ-বাঙ্গিতেও অতিরিক্ত অর্থ আয় করা গেছে। কম খরচে ভালো ফলন আর অধিক লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের কাছে রসুন এখন ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত।
যে কারণে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির দাবি
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, বিশ্বে তৃতীয়তম রসুন উৎপাদনকারী বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ রসুনই উৎপদান হয় চলনবিলের নাটোর জেলায়। এখানে যে ধরণের রসুন উৎপাদন হয় তা দেশের অন্য কোথাও হয়না। ভৌগলিক কারণে নাটোরের বেলে, বেলে-দোআঁশ মাটি, বানের পানির স্থায়িত্ব, ফসলের খেতে নতুন নতুন পলিজমাসহ রোদ-বৃষ্টির মিশ্রণে বিনাহালে কাদায় রোপন করা রসুন অত্যান্ত স্বাস্থ্যকর, রসালো এবং ঝাঁজালো প্রকৃতির হয়। এই রসুন খুব সাধারণ প্রক্রিয়ায় রোদে শুকিয়ে অন্তত ৪ থেকে ৬ মাস সংরক্ষণ করা সম্ভব। এসব গুণাগুণের কারণে দেশজুড়ে এই রসুনের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। পুষ্টি ও ঔষধিগুণ পরিপূর্ণ হওয়ায় এ অঞ্চলের রসুন স্বল্প পরিসরে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। মিলছে ভালো দামও।
স্থানীয় শতবর্ষী বৃদ্ধ আছমত আলী বলেন, তার পিতাও বিনাহালে কাদায় রসুন রোপন করেছেন। তখনকার তুলনায় এখন ফলন আরো বেড়েছে। তিনিও রসুন চাষ করেছেন, এখন তার সন্তানরাও রসুন চাষ করেন। কয়েকটি প্রজন্ম বদলালেও চলনবিলে বিনাহালে কাদায় রসুন রোপনের ধরণ একই আছে। এখানে উৎপাদিত রসুনের স্বাদ-গন্ধ খুবই ভালো। একারণে এই রসুনের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। তিনিও চান চলনবিলের বিনাহালের রসুন আবাদ বিশেষ স্বীকৃতি পাক।
নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন বলেন, স্থানীয় লোকজন ও কৃষকদের দাবির মুখে চলনবিলের রসুনকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এই অঞ্চলের রসুন বিনাহালে উৎপাদন হওয়ায় এর চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। এখানকার রসুনকে জিআইপণ্যের স্বীকৃতি দেওয়া হলে, রসুনের আবাদ, উৎপাদন আরো বাড়ানো যাবে। একই সঙ্গে বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক সুবিধাও নিশ্চিত হবে।
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. আজিজুর রহমান বলেন, চলনবিল অঞ্চলে বিনাহালে কাদায় রসুন রোপন ব্যপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রসুন চাষের জন্য এই অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা দেশের অন্য এলাকায় পাওয়া মুশকিল। এখানকার উৎপাদিত রসুনও অন্য অঞ্চলের তুলনায় আলাদা। তাই তিনিও চান বিনাহালে উৎপাদিত রসুন জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাক।