
—ছবি মুক্ত প্রভাত
বেরজন টুডুর বাড়িটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে। তার পাশের বাড়িটি ছিল মাটির দেয়ালের। সেই দেয়াল ভেঙে তছনছ করা হয়েছে। ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জিনিসপত্র। হাঁড়ির ভাত ফেলে পালিয়েছেন বাড়ির লোকজন। এই কয়েকদিনে সে ভাত পচে গেছে। বাড়ান্দার দড়িতেও ঝুলছে কাপড়চোপড়।
বিএনপিকর্মী বাবলুর সশস্ত্র হামলায় রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামের বারনই নদী তীরের সাঁওতালপাড়ার এমন অবস্থা। গত বুধবার দুই দফা হামলার পরে এখানকার বাসিন্দারা সবকিছু ফেলে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুধু একটি বাড়িতে একজন বৃদ্ধা বাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি। তিনি অমলা দাসী।
অমলা জানালেন, নওগাঁর নিয়ামতপুর থেকে চিকিৎসার জন্য মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে এসেছিলেন। এখানে থেকেই অমলা দাসী রাজশাহীতে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। কিন্তু হাটাচলা করতে পারেন না বলে তিনি আর বাড়ি ছেড়ে পালাতে পারেন নি। তবে তাকে রেখে পরিবারের অন্য সদস্যরা ভয়ে পালিয়ে গেছেন।
তার ভাষ্যমতে, দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ঘরের টিন কেটে ফেলা হয়েছে। কারো কারো ঘরে মশারিও টাঙানো আছে। কিন্তু মানুষ নেই। দুই দফায় হামলা হওয়ায় ভয়ে সবাই বাড়িছাড়া আছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, পবা উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে বারনই নদী। নদীটির তীরে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ। সেখানেই পাঁচ বছর হলো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্টির ১২টি পরিবারের বসবাস। এদের মধ্যে সাতটি সাঁওতাল, চারটি ধাঙ্গড় (ওরাঁও) ও একটি রবিদাস সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে। বাঁধের ওপরেই এসব পরিবারের বসবাস। এখানে বিএনপি কর্মী মো. বাবলুর জমিও রয়েছে। এই ব্যক্তির জমির সামনে ক্ষুদ্র এসব জাতিগোষ্ঠি সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোর বাড়ি করা নিয়ে আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন বাবলু। এনিয়ে বুধবার সকারে বাবলুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে সাঁওয়াতপাড়ার বাসিন্দাদের। তারই জের ধরে প্রথমে বুধবার দুপুরে এবং দ্বিতীয় দফায় সন্ধ্যায় হামলা চালানো হয় এই পাড়ায়। হামলার পর জিনিসপত্র ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন বাসিন্দারা।
সোমবার সরেজমিনে গিয়ে হামলার শিকার বাড়িগুলোতে কোনো বাসিন্দাকে পাওয়া যায়নি। একটি বাড়িতে ছিলেন অমলা দাসী। এই বাড়ির পাশের বাড়িতেও কেউ নেই। ঘরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ঘরের মাটির দেয়ালে টাঙানো আছে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ। ওই কাগজ অনুযায়ী বাড়িটির মালিক শ্যামল মুর্মু। এই সাঁওতালপাড়ার সরদার তিনিই।
সরদার শ্যামলের পরের বাড়িটিও একইভাবে ভাঙচুর করা হয়েছে। পরের বাড়িটির দেয়ালে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ রয়েছে। তাতে দেখা গেল এই বাড়ির মালিকের নাম বেরজন টুডু। বিলের কাগজে মোবাইল নম্বর থাকলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এই বেরজন টুডুর পরের বাড়িতেই চৌকিতে মশারি টাঙানো। বাঁশের দড়জাও ভাঙা। পরের বাড়িটি মাটির দেয়াল বেষ্টিত। মাটির দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঘরের জিনিসপত্রও এলোমেলো। এই বাড়ির হাঁড়িতেই ভাত ছিল। হামলা পরবর্তী সময়ে ভাতগুলো পচে গেছে। রান্না করা ভাত রেখে প্রাণের ভয়ে পালাতে হয়েছে বাড়ির লোকজনকে। পরের বাড়িটির বাড়ান্দার দড়িতে কাপড় ঝুলছে। এই পাড়ার অন্য দুটি বাড়িতেও কোনো মানুষ নেই।
স্থানীয় ভ্যানচালক জানান, ঘটনার দিন প্রথমে বাবলুর সাথে সাঁওতালদের হাতাহাতি হয়। এর পর দুপুরে এবং সন্ধ্যায় দুই দফায় সাঁওতালপাড়ায় হামলা হয়েছে। তার মধ্যে বিকেলের হামলা দলের লোকজনও অংশ নিয়েছিল।
সাঁওতালপাড়ার সরদার শ্যামল মুর্মু বলেন, তাদের আদি বাড়ি গোদাগাড়ি। সেখান থেকে এই এলাকায় এসে কৃষি কাজ করতেন। কৃষকদের সুবিধার্থে এলাকার লোকজন বছর পাঁচেক আগে বাঁধের ওপর বাড়ি করতে দিয়েছিলেন। হামলার পর যে যেভাবে পেড়েছেন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
তিনি আরো বলেন, ঘটনার দিন ময়লা ফেলা নিয়ে বাবলুর সাথে পাড়ার মালতী নামের এক নারীর ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে ওই নারীকে মারধর করেন বাবলু। এসময় পাড়ার ছেলেরা বাবলুকেও মারে। ঘটনার পর মালতিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দুপুরে বাবলু লোকজন নিয়ে পাড়ার হরি, হরির স্ত্রী ও মেয়েকে মারধর করেন। পুলিশ এসে দুই পক্ষকেই শান্ত থাকতে বলে। তবু বাবলু দ্বিতীয় দফায় সন্ধ্যায় আবারো হামলা চালান। হামলকারীদের হাতে হাঁসুয়া, বল্লম ও ছোরা ছিল। এমন সশস্ত্র আক্রমণ দেখে সাঁওতাল পাড়ার বাসিন্দারা পালিয়ে গেছেন। এ ঘটনায় প্রশাসনের কাছে অভিযোগও দিয়েছেন তিনি।
বাবলুর স্ত্রী ডলি বেগম বলেন, তাদের জমির সামনে সাঁওতালপাড়া। খুব অত্যচার করে। জমিতে ফসল ফলাতে দেয়না পাড়ার লোকজন। সেদিন মদ খেতে নিষেধ করায় তার স্বামীকেই মেরেছেন সাঁওতাল পাড়ার লোকজন। সাঁওতালদের ঘর তার স্বামী বাবলু ভাঙেননি।
সাঁওতালদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়অর কথা স্বীকার করেছেন পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরাফাত আমান আজিজ। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
পবা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, বাবলু থানায় অভিযোগ দিয়েছেন। সাঁওতালদের পক্ষ থেকেও শ্যামল, তার স্ত্রী ও ছোটন নামের এক ব্যক্তিও বিষয়টি থানায় জানিয়েছেন। তাদের আদালতে মামলা দায়ের করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।