
মাথাগুঁজার ঠাঁই হারিয়ে বিলাপ করছেন বৃদ্ধ শঙ্করী দাসী।-ছবি মুক্ত প্রভাত
১৯ শতাংশের এক খণ্ড ভিটায় বাস করছিলেন শঙ্করী দাসী। নব্বইয়ের দশকে ১৯ শতাংশের ৯ শতাংশে জায়গা হয় ভূমিহীন আকবর আলীর। সেই থেকে হিন্দু-মুসলিম পরিবার দুটো মিলেমিশে এক ভিটেয় বসবাস করছিলেন। বিনা নোটিশে ২৩ এপ্রিল পরিবার দুটোকে আদি নিবাস থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
সোভাজান নামের এক নারীর দায়ের করা উচ্ছেদ মামলায় আদালতের আদেশের কথা বলে তড়িঘড়ি করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চারটি থাকার ঘর, টয়লেট ও টিউবওয়েল। শঙ্করী দাসী আর আকবর আলীর এই নিবাস ছিল গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের গজেন্দ্র চাপিলা গ্রামে। উচ্ছেদের পর থেকে এই দুই পরিবারের বৃদ্ধ, নারী-শিশুসহ ১৪ সদস্যের জায়গা হয়েছে গ্রামের পাকা সড়কে।
চাপিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুর রহমান বলেন, যে ভিটা থেকে দুটি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এই জমিটি অর্পিত সম্পত্তি (ভিপি) হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে লীজ নিয়ে শঙ্করী দাসী ও আকবর আলী পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানেই বসবাস করছিলেন। কোনো নোটিশ ছাড়া ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে উচ্ছেদের ঘটনায় শঙ্করী রানী বাদি হয়ে সোমবার রাতে গুরুদাসপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে সোভাজান বিবির ৫ পূত্রসহ ৬জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসাদুল ইসলাম জানালেন, অর্পিত সম্পত্তিতে বসবাস করা দুটি পরিবারকে আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ করা হলেও এ ব্যপারে তারা কোনো নোটিশ বা আদেশ পাননি। অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্ত করতে তারা আদালতে কোনো প্রতিবেদনও দাখিল করেননি। ফলে কাগজপত্র অনুযায়ী উচ্ছেদের শিকার পরিবার দুটির নামেই এখনো ওই জমির লীজ বহালই রয়েছে।
চাপিলা ইউনিয়ন ভূমি অফিস জানিয়েছে, গজেন্দ্র চাপিলা মৌজার আরএস ৫৭ নম্বর খতিয়ানভুক্ত ৭৫ নম্বর দাগের ২১ একর জমির মালিক পাশ^বর্তী সিংড়া উপজেলার কলম গ্রামের যোগেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস। তবে ওই সময় থেকেই এই জমিটিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন ভানু রায়। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব শুরু হলে যোগেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস ভারতে চলে যান। ফলে সবশেষ ৭২ সালের ভূমি রেকর্ড অনুযায়ী ১.৩৫ একর জমি অর্পিত হিসেবে রেকর্ডভুক্ত হয়। এরপর নব্বইয়ের দশকে একই ভিটাতে আকবর আলীকে আশ্রয় দেন ভানু রায়ের পরিবারের লোকজন। ১৯৮৯ সালে ১.৩৫ একরের মধ্যে শঙ্করী দাসীর মা ভানু রায়ের নামে ১০ শতাংশ, আকবর আলীর নামে ৯ ও স্থানীয় মকসেদ আলীর নামে ২৫ শতাংশসহ মোট ৪৪ শতাংশ জমি লীজ দেয় সরকার।
ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দাখিল করা সোভাজান বিবির কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ভানু রায় আকবর আলীর সঙ্গে ১৯৮৯ সালে ২৫ শতাংশ জমি লিজ নিয়েছিলেন সোভাজান বিবির স্বামী মৃত মকছেদ আলীও। অথচ তিন জনের লিজ নেওয়া ওই ৪৪ শতাংশ জমি ১৯৭৪ সালে ৯৭৪ নম্বর দলিলে ভারতে পারি জমানো যোগেন্দ্র চন্দ্রের ওয়ারিশদের কাছ থেকে সোভাজানের নামে ক্রয়ের দাবি করা হচ্ছে। ফলে কোনো কারণ উল্লেখ ছাড়াই ২০১৩ সাল থেকে শঙ্করী দাসী ও আকবর আলীর ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) গ্রহণ বন্ধ করেছে ইউনিয়ন ভূমি অফিস।
শঙ্করী দাসী বলেন, ব্রিটিশ শাসনের সময়ও মা ভানু রায়ের সাথে তিনি এই ভিটেতেই বাস করতেন। কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই অচমকা ২৩ এপ্রিল তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো জমি না থাকায় এখন তারা পরিবারের ৯ সদস্য নিয়ে সড়কে তাবু পেতে ঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন।
আকবর আলী বলেন, তারা আদালতের কোনো নোটিশ পাননি। কিছু বুঝে উঠার আগেই লোকভাড়া করে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছেন সোভাজানের ছেলে আবু হানিফ। হানিফের বিরুদ্ধে ভূমি অফিসের দালালি ও জাল নিবন্ধন সনদে কলেজে জাকরি করার অভিযোগও রয়েছে।
সম্প্রতি গুরুদাসপুর সহকারী জজ আদালত থেকে উচ্ছেদ মামলায় রায় পাওয়ার দাবি করে সোভাজান বিবির ছেলে আবু হানিফ বলেন, আদালতের নিষেধ থাকায় তারা সাংবাদিকদের কাছে কাগজপত্র সরবরাহ করতে পারছেন না।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা আফরোজ বলেন, ওই জমি থেকে বসতি উচ্ছেদ বা অর্পিত জমি অবমুক্তির বিষয়ে আদালত থেকে তিনি কোনো আদেশ পাননি। তবে উচ্ছেদের খবর শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাধ্যমতো সহায়তা দিয়েছেন ভুক্তভোগি পরিবার দুটিকে।