
—ছবি মুক্ত প্রভাত
কেউ এসেছেন পরিবারের সঙ্গে, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে। অনেকেই আবার ঘুরে ঘুরে দেখছেন হাজার বছরের পুরোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, অবার কেউ কেউ মুঠোফোনে সেলফি ও গ্রুপ ছবি তুলছেন।
দর্শনার্থীদের এমন উপচে পড়া ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে নওগাঁর বদলগাছীর ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুর। ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে হাজার হাজার দর্শনার্থী ছুটে আসছেন এই ঐতিহাসিক স্থানে।
গতবারের চেয়ে এবার ঈদুল ফিতরে ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনে দর্শনার্থী বেড়েছে অনেক। ঈদের দিন গত সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্প্রতিবার ও শুক্রবার ছিলো দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। চোঁখে পড়ার মতো ছিলো দর্শনার্থী।
এবার ঈদে সরকারি ও বেসরকারী চাকরিজীবীদের ছুটি বেশি থাকায় আনন্দ উপভোগ করতে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে ছুটে এসেছেন। নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো থাকায় দর্শনার্থীরা ঘুরতেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত হলেও এটি জয়পুরহাট জেলা শহরের কাছাকাছি। জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে পাহাড়পুর মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে।
তাই বিভিন্ন স্থানের লোকজন রেলপথে জয়পুরহাট এসে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে আসছেন। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৌদ্ধবিহারের বিভিন্ন পয়েন্টে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ছাড়া যানজট এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে। একারনে এবছর যানজটও নেই বললেই চলে। এতেকরে দর্শনার্থীরা যাতায়াত করে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
সরেজমিনে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে গিয়ে দেখাযায়, দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। অনেকেই পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে পাহাড়পুর ঘুরতে এসেছেন। এ সময় অনেককে সেলফি তুলতেও দেখা যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থাও ছিল চোখে পড়ার মতো। দর্শনার্থীরা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের চতুর্দিক ঘুরে ঈদের আনন্দ উপভোগ করছেন।
ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে রয়েছে সৌন্দর্য বর্ধনশীল ও আকর্ষনীয় মূল প্রবেশদ্বার। প্রবেশ দ্বারের দক্ষিন পাশের্বর কক্ষে রয়েছে প্রত্ন সামগ্রী ও বই। উত্তর পাশের্ব কক্ষে রয়েছে টিকিট কাউন্টার।
তাঁর পাশের্ব রয়েছে মহিলা টয়লেট ও পুরুষ টয়লেট। আরো আছে ১টি মসজিদ। রয়েছে অফিসারদের জন্য কোয়ার্টার, ব্যাটিলিয়ানদের জন্য আনসার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার। দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য রয়েছে ১০টি ছাউনী সেই ছাউনি। আর এই ছাউনী গুলিতে ক্লান্ত দর্শনার্থীরা বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আর দর্শনার্থীর ছাউনিগুলোর পাশের্বই রয়েছে পুরাতন আদলে নির্মিত ১টি পুকুর। এছাড়া পাথওয়ের মাঝে রয়েছে বসার স্থান।
আর এ পাথওয়েগুলো নির্মাণ করা হয়েছে মনোরোম পরিবেশে । রয়েছে গাড়ী পার্কিং এর জায়গা। এর মধ্যে পিকনিক কর্নার থেকে সরাসরি বৌদ্ধ মন্দির প্রব্রেশ পথে রয়েছে ১টি ব্রিজ। বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান ফটক সহ ভিতরে রয়েছে মোট ৩টি ব্রিজ। আর বৌদ্ধ মন্দিরের চুড়ায় উঠার জন্য যে কাঠের সিঁড়ি আছে সেটি অকেজো হয়ে পরে আছে । আর পাহাড়পুরের এসব দৃশ্য দেখে যেন মন ভরেযাবে যেকোন কারো।
জানা যায়, এবছর ঈদুল ফিতরের ছুটির দিনে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও রাজধানী ঢাকা থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী আনন্দ করতে এই ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহার পাহাড়পুরে ছুটে এসেছেন।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে গিয়ে দেখা যায়, দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। অনেকে বাস-ট্রাক, মাইক্রোবাস, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেলে করে এসেছেন। অনেক গাড়িতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছিল। দর্শনার্থীদের সুশৃঙ্খলভাবে প্রবেশের জন্য দুটি ফটকের সামনে নারী-পুরুষের আলাদা লাইন করা হয়েছে।
আর দর্শনার্থীদের আগমন উপলক্ষে বৌদ্ধবিহার পাহাড়পুর সংলগ্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ কসমেটিস ও ঝিনুকের দোকানগুলো দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন বর্ণিল সাজে সাজিয়েছেন দোকানিরা।
দোকানীরা জানান, এই রোজার ঈদের পাঁচ থেকে সাত দিন ব্যপক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এই বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুরে। আর প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ হাজার দর্শনার্থী এই পাহাড়পুর পরিদর্শন করতে আসে।
বিভিন্ন জায়গার ভ্রমণ প্রিয়াসি দর্শনার্থীদের সাথে কথা বললে তারা বলেন, ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুরের নাম আমরা অনেক শুনেছি ও জেনেছি কিন্তু সময়ের অভাবে এটি বাস্তবে দেখার সময় হয়নি। আর এ বছর ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে এসে বাস্তবে এতো সুন্দর দৃশ্য দেখে খুব ভাল লাগছে।
দিনাজপুরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা ছয়জন বন্ধু ৩টি মোটরসাইকেল নিয়ে এই পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে এসেছি। জয়পুরহাট থেকে পাহাড়পুরের দূরত্ব খুবই কম। আবার যোগাযোগব্যবস্থাও ভালো। পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে এসে আমরা সবাই খুবই আনন্দ পেয়েছি।
দর্শনার্থী তরিকুল, সপ্না, শেলি, রকি, নাজমুল ও সাদিয়া সহ অনেকেই বলেন, আমরা এখানে এর আগে বহুবার এসেছি । কিন্তু এবার এখানে এসে মনে হচ্ছে নতুন এক বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুরকে দেখছি ও পুরো পাহাড়পুরটি পরিদর্শন করে আমরা খুবই আনন্দ পেয়েছি ।
দর্শনার্থী নাহিদ ও সাব্বির বলেন, অনেক দিন ধরে এখানে আসার ইচ্ছা ছিল। এবার সুযোগ হওয়ায় দেখতে এলাম। এত বছর আগে নির্মিত বিশাল স্থাপনা দেখে সত্যিই আমরা বিস্মিত হয়েছি।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শফিকুর রহমান পরিবার নিয়ে এসেছেন বগুড়ার আদমদীঘি থেকে। তিনি বলেন, পরিবারের সবাই পাহাড়পুর দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। তাই ঈদের আনন্দ বাড়াতে এখানে আসা।
ঈদুল ফিতরের দিন গত সোমবার থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে মানুষের ঢল নেমেছিল। ৫ দিনেই টিকিট বিক্রি হয়েছে ১৮ লাখ ৭১ হাজার ৯৯০ টাকার। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশের জন্য পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোন টিকিট প্রয়োজন হয় না।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘর কাস্টডিয়ানের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈদের দিন সোমবার সকাল ১০টা থেকে দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়া হয়। সোমবার ঈদের দিন ১৮ হাজার ৬৭৮ জন দর্শনার্থী প্রবেশ করেন এবং টিকিট বিক্রি হয় ৫ লাখ ৮০ হাজার ৩৮০ টাকার। ঈদের ২য় দিন মঙ্গলবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৯৪৮ জন, আর টিকিট বিক্রি হয়েছে ৪ লাখ ৯০ হাজার ১৭০ টাকার। ঈদের ৩য়দিন বুধবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৯৫৫ জন, টিকিট বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৪৭০ টাকার।
ঈদের ৪র্থ দিন দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৬৮৯ জন, টিকিট বিক্রি হয়েছে ২লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকার। ঈদের ৫ম দিন দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৬১৬ জন, টিকিট বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭০ টাকার। জাদুঘর কর্তৃপক্ষের ধারণা, ঈদের ছুটি বেশি থাকায় আরো ২-১ দিন দর্শনার্থীর সমাগম বেশি হবে এই পাহাড়পুরে।
পাহাড়পুর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু বলেন, গতবারের তুলনায় এবার ঈদে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এসেছেন। রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ও আনসার ব্যাটিলিয়ানের ব্যবস্থা থাকায় এবার যানজট নেই। ঈদের ছুটিতে রেকর্ড পরিমাণ দর্শনার্থী আসছে এই পাহাড়পুরে। তিনি আরো বলেন, দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছাউনি ও বেঞ্চ। এতে করে এই গরমে দর্শনার্থীরা খুব বেশি ক্লান্ত হচ্ছে না।