
—ছবি মুক্ত প্রভাত
৫শ কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে যাতায়াত করতে বেশকিছু টাকা খরচ হয়। একারণে স্বল্প সময়ের ছুটিতে বাড়িতেও আসেন না বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস টুম্পা (২১)। এবার ১৫ দিনের লম্বা ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার খরচ যোগাতে তিনি গ্রামের বাজারে শুরু করেছেন ডিম বিক্রি।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার মেরিগাছা বাজারে খোলা আকাশের নিচে বসে প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সিদ্ধ ও কাচা মিলিয়ে অন্তত ৬০০ থেকে ৭০০ টি ডিম বিক্রি করছেন। এতে যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার খরচ বাদেও হাত খরচ থেকে যাবে। জান্নাতুল ফেরদৌস টুম্পা উপজেলার নগর ইউনিয়নের দোগাছি গ্রামের আবদুর রহিমের মেয়ে।
জান্নাতুল ফেরদৌস টুম্পার ডিম বিক্রির ছবি তুলছেন অনেকেই। অনেকেই আবার ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে পোস্ট করছেন। তবে এতে ত্যক্ত-বিরক্ত হচ্ছেন না। বরং নিজের মতো ডিম বিক্রির কাজ করছেন তিনি। ভ্যানচালক বাবার চাপ কমাতে তিনি এই ডিম বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন বলে মুক্ত প্রভাতকে জানিয়েছেন।
জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, ভানচালক বাবার পক্ষে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জোগানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের বাড়ির ভিটে ছাড়া জমাজমিও নেই। এবার তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বষে অধ্যায়ন করছেন। ভ্যানচালিয়ে বাবা যে টাকা পাঠান, তা দিয়ে খাওয়ার খরচের বাইরে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই তিনি স্বল্প সময়ে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে আসতে পারেন না।
এবার তিনি ১৫ দিনের ছুটি কাটাতে ২৩ জানুয়ারি বাড়িতে এসেছেন। আসার সময় যাওয়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তা জেঁকে বসে। আসতে আসতে তিনি যাওয়ার খরচ জোগাতে ডিম বিক্রির পরিকল্পনা করেন। সেই ভাবনা থেকেই বাড়ি আসার পরদিন থেকে তিনি ডিম বিক্রি শুরু করেন। প্রতিদিন বিকেলে বাবার ভ্যানে চড়ে গ্রামের মেরিগাছা বাজারে আসেন। করেন ডিম বিক্রি।
জান্নাতুলের পরিবার জানিয়েছে, স্কুল-কলেজে পরার সময় খুব মেধাবি ছিলেন জান্নাতুল টুম্পা। ‘স্থানীয় খলিসাডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তীর সুযোগ পান। তখন থেকেই শুরু টুম্পার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর দুশ্চিন্তা বাড়ে ভ্যানচালক পিতার।
জান্নাতুল বলেন, ছোট এবং স্বল্প পুজির ব্যবসা হিসেবে ডিম বিক্রির পরিকল্পনা তার মাথায় আসে। স্থানীয় বনপাড়ার আড়ত থেকে ডিম কিনে এনে প্রতিটি সেদ্ধ ডিম তিনি বিক্রি করেন ১৫ টাকায়। তবে দুটি ডিম এক সঙ্গে কিনলে ২৫ টাকায় বিক্রি করেন। এছাড়া কাঁচা ডিম বিক্রি করেন প্রতি হালি ৪২ টাকায়। অন্য বিক্রেতাদের চেয়ে তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করায় বেশি ডিম বিক্রি করতে পারেন তিনি। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবেন। সে পর্যন্ত তিনি ডিম বিক্রি করতে চান।
জান্নাতুলের ডিম বিক্রির দৃশ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর এনিয়ে অনেকই নানা রকমের মন্তব্য করছেন। কায়েস উদ্দিন নামে একজন লিখেছেন, ‘কোনো কাজই যে ছোট না, এই সচেতন শিক্ষার্থী তারই উদাহরণ। আমরা এর থেকে শিক্ষা নিতে পারি।’ নওশিন তাবাচ্ছুম আইশা লিখেছেন, ‘এটা একটা চমৎকার কাজ।’
অন্যরে মন্তব্য নিয়ে জান্নাতুল বলেন, ‘ তার ডিম বিক্রি নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন। এতে কিছু আসে যায় না। আমি সৎভাবে হালাল পন্থায় উপার্জন করছি। ডিম বিক্রি নিয়ে আমি নিজেকে একজন অতিক্ষুদ্র এবং গরিব উদ্যোক্তা মনে করছি।’
তিনি বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর লেখাপড়া নিয়ে তিনি বেশ চিন্তায় পড়েছিলেন। হয়তো টাকার অভাবে লেখাপড়া ছেড়ে থেমে যেতে হবে। বাবা দরিদ্র ভ্যানচালক হলেও কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। খেলাপড়া শেষ করে তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করতে চান।
জান্নাতুলের বাবা আবদুর রাহিম বলেন, ‘আমার ভ্যানে করেই আমি আমার মেয়েকে এই বাজারে নিয়ে আসি ও নিয়ে যাই। সে অনেক কষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। ছুটিতে এসে সে এই ডিম বিক্রি করছে আমার প্রতি মায়া করে। যাওয়ার সময় অনেক টাকা ভাড়া লাগে। সেই ভাড়া জোগাড় করতেই সে ডিম বিক্রি করছে। ওর জন্য সবাই দোয়া করবেন যেন, সে যোগ্য ও সৎ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে।’
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা সাহেব জানান, টুম্পা স্কুলজীবন থেকেই সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি অনেক মেধাবী। ছুটিতে বাড়িতে এসে ডিম বিক্রির এই কাজ সবার জন্য অনুপ্রেরণামূলক।
বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লায়লা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষার্থী জান্নাতুল টুম্পাকে নগদ অর্থ সহায়তা দেবেন তিনি। তাছাড়া ওই শিক্ষার্থীর পিতাকে একটি নতুন ভ্যান কিনে দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে তাদের।