
—ছবি মুক্ত প্রভাত
কুড়িগ্রামের চিলমারী মহিলা ডিগ্রী কলেজটি শুধু মাত্র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জীতেন্দ্র নাথ বর্মণের অদক্ষতা, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, নিয়োগ বাণিজ্য ও কলেজের জমি অধিগ্রহণের টাকা তছরুপসহ আর্থিক র্দূনীতির কারণে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্নের পাশাপাশি প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে বলে অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে।
কলেজের সাধারণ শিক্ষকরা তার এই সকল র্দূনীতির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে অভিযোগ করেও কোন সুরাহা পায়নি।
অপরদিকে আ’লীগপন্থী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কর্তৃক একই দলীয় আদর্শে বিশ^াসী সাবেক কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েও উক্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে প্রতিবেদনটিই লাল ফিতায় বন্দী করে ওএসডি হয়ে কুড়িগ্রাম ছেড়েছেন মর্মে জানাগেছে।
গত ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফজলুল হক চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলে উপাধ্যক্ষ জীতেন্দ্র নাথ বর্মন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই জীতেন্দ্র নাথ বর্মন সীমাহীন র্দূনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। অপরদিকে স্থানীয় আওয়ামীলীগের উপজেলা কমিটির প্রভাবশালী নেতা সুনীল চন্দ্র বর্মণ ওরফে চিনু ডাক্তার উক্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের আপন বড় ভাই হওয়ায় তার প্রভাব খাটিয়ে তিনি কলেজটিকে দীর্ঘদিন যাবৎ নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে যা ইচ্ছা তাই করে কলেজটিকে ধংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন।
তৎকালীন আ’লীগ সভাপতি প্রয়াত শওকত আলী সরকার (বীর বিক্রম) সেই মুহূর্তে একাধারে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চিলমারী মহিলা ডিগ্রী কলেজের গর্ভানিং বডির সভাপতি ছিলেন। খুব সহজেই আ’লীগ নেতা বড় ভাই সুনীল চন্দ্র বর্মনের মাধ্যমে ২২ লক্ষ টাকায় রফাদফা করে কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ নিয়েছিলেন মর্মে গুঞ্জন আছে।
কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফজলুল হক এর অবসর গ্রহণের পর অভিযুক্ত জীতেন্দ্র নাথ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করে কলেজের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা হাতে পাবার পর থেকেই তৎকালীন গর্ভানিং বডির সভাপতি ও একজন কলেজ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের সহযোগিতায় তিনি কলেজটিকে দূর্নিতীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষকরা গত ২০২১ ৪ ডিসেম্বর কলেজের সাধারন শিক্ষকগণ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জীতেন্দ্র নাথ বর্মনের বিরুদ্ধে কলেজের গর্ভানিং বডির সভাপতি বরাবরে র্দূনীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার লিখিত একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে সহনশীল পর্যায়ে এলে তৎকালীন সরকার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে কলেজ বন্ধ রেখেই ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষ ও ২০২০-২০২১ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যাসাইনমেন্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
করোনাকালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের অধীন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অ্যাসাইমেন্ট পরীক্ষার বিপরীতে কোন প্রকার ফিস গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারী করলেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জীতেন্দ্র নাথ বর্মন উক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের নিষেধাজ্ঞাকে তোয়াক্কা না করে ২০১৯-২০২০ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধ্যায় প্রতি ২৫ টাকা হিসাবে জন প্রতি ৭টি অধ্যায়ের বিপরীতে মোট ১৬৩জন শিক্ষার্থীর নিকট থেকে মোট এক লাখ একাত্তর হাজার একশত পঞ্চাশ টাকা ও ২০২০-২০২১ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে অধ্যায় প্রতি ২৫ টাকা হিসেবে জনপ্রতি ৮টি অধ্যায়ের বিপরীতে ১৬০জন শিক্ষার্থীর নিকট থেকে বিনা রশীদে কলেজের শিক্ষক আনিছুর রহমান ,নজরুল ইসলাম, নুর ইসলাম ও হুমায়ূন কবীরের সহযোগিতায় এক লক্ষ বিরানব্বই হাজার টাকা মিলে মোট তিন লক্ষ তেষট্টি হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্নসাৎ করেন।
এছারাও অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণির ভর্তির জন্য কোন কমিটি গঠন না করে নিজেই ৮৬ জন ছাত্রীর নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা বিনা রশিদে গ্রহণ করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে, তিনি ১ ও ২ নং রশিদ বহি নিজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রশিদে ফ্লুইট মেরে কলম দিয়ে কাটাচিরা ও ওভার রাইটিং করে টাকার অংক পরিবর্তন করে গোঁজামিলের একটি হিসেব দাঁড় করান।
এছাড়াও অভিযোগে আরও বলা হয়, কলেজের ১৭টি মেহগিনি গাছ নিলামের মাধ্যমে ৫০,০০০/-(পঞ্চাশ হাজার) টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্ত তিনি উক্ত টাকা কলেজের ব্যাংক একাউন্টে জমা না করে ভূয়া বিল ভাউচার করে সম্পূর্ণ টাকা আত্নসাৎ করেন। এছাড়াও তিনি রাতের অন্ধকারে ৫০/- (পঞ্চাশ) হাজার টাকা সমমূল্যের আরও ৫টি মেহগিনি গাছ জিবির সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিজে বিক্র করে উক্ত টাকাও আত্নসাৎ করেন।
এছাড়াও ভূয়া ভাউচার দিয়ে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল উত্তোলন করে আত্নসাৎ করছেন মর্মে উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সমূহ তদন্তপূর্বক বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানো হয়। কিন্ত অজ্ঞাত কারনে কলেজ জিবির সভাপতি প্রয়াত শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম (আ’লীগের চিলমারী শাখার সভাপতি) এ বিষয়ে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থেকে উল্টো র্দূনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে আন্দোলন দমিয়ে রাখার অপকৌশল গ্রহণ করেছিলেন।
সভাপতি শওকত আলী সরকারের যোগসাজসে চিলমারী মডেল থানার তৎকালীন ওসি(তদন্ত) প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথের সহযোগিতায় ও পরামর্শে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজটির আন্দোলনরত বিএনপিপন্থী তিনজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম এ্যাক্টে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। শিক্ষক তিনজন হলেন রফিকুল ইসলাম স্বপন, নাজমুল হুদা পারভেজ ও ফজলুল হক।
মামলা-হামলাকে উপেক্ষা করে সাধারন শিক্ষকগণ ২১/০৭/২০২২ ইং তারিখে আবারও আরেকটি লিখিত আবেদন জিবির সভাপতি প্রয়াত শওকত আলী সরকার (বীরবিক্রম) এর নিকট দাখিল করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান। দ্বিতীয় অভিযোগে অভিযোগকারীগণ কলেজের জমি রাস্তার প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করে সরকারের পক্ষ থেকে কলেজকে জমির বিপরীতে যে টাকা প্রদান করেছিল,সেই অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণের টাকার হিসাব প্রকাশের দাবি পূর্বের অভিযোগ গুলির সাথে নতুন করে সংযোজন করেন।
বারবার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাওয়া স্বত্বেও দীর্ঘদিন কালক্ষেপণের এক পর্যায়ে সাবেক সভাপতি অসুস্থতা জনিত কারণে মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তৎসময়ের কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কলেজ জিবির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
গত ২১/০৯/২০২২ ইং তারিখে উক্ত জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষকগণ সাক্ষাৎ করে আবারও লিখিত ভাবে একই অভিযোগ তার নিকটও দায়ের করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান। সাবেক ডিসি মোহাম্মদ রেজাউল করিম কলেজের গর্ভানিং বডির মিটিং ডাকবেন কথা দিলেও হঠাৎ তার বদলিজনিত কারণে তিনি আর সময় দিতে পারেননি। ডিসি মোহাম্মদ রেজাউল করিমের বদলির পর কুড়িগ্রাম জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক পদে মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ যোগদান করেন এবং তিনি পদাধিকার বলে চিলমারী মহিলা ডিগ্রী কলেজের গর্ভানিং বডির সভাপতি হন।
২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি কলেজের সাধারণ শিক্ষকগণ নবনিযুক্ত ডিসি মোহাম্মদ সাইদুল আরীফের নিকট লিখিত ভাবে একই অভিযোগ আবারও দাখিল করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান। ডিসি আরীফ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করবেন বলে শিক্ষকদেরকে আশ্বস্ত করলেও কার্যত তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জীতেন্দ্র নাথ বর্মণ কর্তৃক ম্যানেজ হয়ে যান এবং গর্ভানিং বডির মিটিং না ডেকে কালক্ষেপন করতে থাকেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় তিনি আ’লীগ পন্থী ক্যাডার ছিলেন।
বাধ্য হয়ে কলেজের শিক্ষকরা গত ১০ জুলাই ২০২৩ ইং তারিখে দুর্নীতিগ্রস্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জীতেন্দ্র নাথ বর্মনের পদত্যাগ চেয়ে কলেজের প্রধান ফটক সংলগ্ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের র্দূনীতির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিষয়টি ডিসি আরীফকে জানালে, ডিসি আরিফ সকল আন্দোলনকারী শিক্ষককে চাকুরি থেকে সাসপেন্ড করার হুমকি প্রদান করেন।