
—ছবি সংগৃহিত
১৬ ডিসেম্বর ২০২৪। দেশজুড়ে সিমছামভাবে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালের এই দিনে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জন্ম নেয় বাংলা ভাষা, লাল সবুজের পতাকা আর স্বাধীন ভূখণ্ড। বাঙালি জাতী পায় মুক্তির আস্বাদ।
কত রক্ত, কত প্রাণের বলিদান আর ২ লাখ নারীর সম্ভ্রম। সবমিলিয়ে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। এসবই হয়েছে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। অথচ আজকে 'বাঙালির ৫৪তম মহান বিজয়োল্লাসের দিনে কোথাও শেখ মুজিবের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।' বিজয়ের ব্যানার-ফেসটুন, দাওয়াত পত্র কোথাও শেখ মুজিবের নাম ছবি ব্যবহার হয়নি! এক রকম বাঙলার কোথাও শেখ মুজিবের অস্তিত্ব নেই।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে একটু ঘুরে আাসা যাক। আমার পিতা মো. জাফর আলী প্রামাণিক ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সম্মুখ যোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁর সৌভাগ্য হয়েছিল শেখ মুজিবের একটি সমাবেশে সাধারণ শ্রতা হিসেবে উপস্থিত থাকার। সময়টা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আগের কোন এক তারিখ হবে।
আমার পিতা মো. জাফর আলী প্রামাণিকের ভাষ্যমতে- গুরুদাসপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন। তিনি নৌকা প্রতিকে ভোট চাইলেন। মঞ্চে বক্তৃতার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘ভাইয়েরা আমাকে নৌকা প্রতিকে ভোট দেবেন। আমি জয়যুক্ত হতে পারলে, কৃষক ভাইদের ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাওকুফ করে দেব। তোমাদের নামে সার্টিফিকেট মামলা হবে না। গরিব দুখিদের জন্য বাসস্থান করে দেব। জেলে ভাইদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দেব, তাদের জমি দেব, তাঁতি ভাইদের জন্য তাঁত করে দেব। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৬০টি কাপড়ের মিল রয়েছে। বাংলাদেশে একটিও নেই। আমি মিল করে দেব। যাতে আমার শ্রমিক ভাইরা খেটে খেতে পারেন। চার আনা সের চিনি খাওয়াব। বাংলাদেশের মানুষকে আমি ভাতে মরতে দেব না।’
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে আমারা আপ্লুত হয়ে পড়লাম। বঙ্গবন্ধুর নৌকা প্রতিকে ভোট দেয়ার জন্য দুই হাত তুলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। ওই সমাবেশ থেকে গ্রামে ফিরে ১০ পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে আওয়ামী লীগের সদস্য হলাম। গ্রামে আওয়ামী লীগের কমিটি কঠন করলাম। সেসময় চলনালী গ্রামের ঈমান উদ্দিন সরকার, উত্তরনারিবাড়ি গ্রামের হাসান উকিল, সন্তোসপুর গ্রামের গুল মাহমুদ, পলশুড়া গ্রামের গুল মাহমুদ মহুরী, সিধুলী গ্রামের রিয়াজ শাহ, চাঁদ চেয়ারম্যান,ধারবারিষার নজির মন্ডল, তালবাড়িয়ার আলিম উদ্দিন চেয়ারম্যান, চাঁচকৈড়েরর হাকিম সরকার, এন্তাজ মোল্লা, কায়েম বিশ্বাসদের নিয়ে কমিটি গঠন হলো।
আমরা নৌকায় ভোট দিলাম। বঙ্গবন্ধু জয়ি হলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কাছে গদি ছাড়া হয়নি। তার পর থেকেই আমাদের সেই কমিটি স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটিতে পরিণত করা হলো। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন। সেই ডাকে সারা দিয়ে আমরা যুদ্ধের জন্য পুরো প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। ২৬ মার্চের পর হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম নাটোরের ওয়ালিয়া নামকস্থানে পাকিস্তানি মিলিটারি আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক লাঠি, ফলা, হাসুয়াসহ যা তাই নিয়ে আমরা ওয়ালিয়াতে গেলাম। সেসময় ওই অভিযানে ছিলেন- গুরুদাসপুরের ছাইমউদ্দিন, আব্দুল কাদের, বাচ্চু, সেকেন্দারসহ অনেকই (তার কাছে রাইফেল ছিল)। ওয়ালিয়াতে গিয়ে দেখলাম ট্রাকের ওপর ত্রীপল দিয়ে কয়েকজনের লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। আজাহার মাস্টারকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশটি ঝুলন্তই আছে। তিনদিন থাকার পর ওখান থেকে ফিরে আসলাম। তখন চারিদিকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেবল গুরুদাসপুরে কোন যুদ্ধ নেই। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পের খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। এরমধ্যে হঠাৎ করেই গুরুদাসপুরে ১৭জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করল পাক বাহিনী।
যুদ্ধে যাওয়ার আঙ্খাকা আরো বৃদ্ধি পেল। ১ বছরের ছেলে আর স্ত্রীসহ বাবা-মাকে না জানিয়ে তৎকালিন মির্জাপুর হাটে গেলাম। সেখানে গিয়েই দেখা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যড. তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুস সাত্তার, মকবুল, আনিসের সাথে। নৌকা নিয়ে তাদের সাথে চলে গেলাম নওগাঁর ক্যাম্পে।
সেই থেকে জাফর আলী প্রামাণিকরা পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু করলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন মাতাকে মুক্ত করলেন। যুদ্ধের যাওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠের ডাক-ই পাথেয় হয়েছিল জাফর আলীর মতো লাখ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার। তাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম্য বাংলাদেশ।
অথচ সেই শেখ মুজিবকেই আজ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ৭১ এর পর থেকে বহুবার রাজনীতির পালাবদল ঘটেছে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর বহুল কাঙ্খিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা এসেছে। এরপরও ক্ষমতার অদল বদল হয়েছে। ২০২৪ সালে এসে স্বৈরাচার হিসেবে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। সেটি যেমন ঠিক আছে, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলমত নির্বিশেষে সারা বাংলার অবিসংবাদিত একজন নেতা। যার ডাকে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পটভূমির কারণে বঙ্গবন্ধুর নামটি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা কেবল বোকামিই নয়, রিতিমতো রাষ্ট্রদোহের সামিলও।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মহান বীর মুক্তিযোদ্ধের আত্মত্যাগের কথা আর বঙ্গবন্ধুর ত্যাগকে একটা সত্তার লোকেরা ভুলে যেতে চাইছেন। একটা জাতীকে মুক্তি দিয়ে স্বাধীন ভূখন্ডের সাথে মায়ের ভাষা বাংলা দিয়ে গেলেন, তাদেরেই অস্তিত্ব সংকট হয়। সেখানে স্বৈচার এরশাদ পতনের সময় শহীদ হওয়া নুর হোসেনকেই বা কজন মনে রেখেন। অথবা ২০২৪ অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধদের-ই বা কয়দিন মনে রাখা হবে...?
তাই দায়িত্বশীলদের প্রতি আমার আহ্বান- যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন অথবা যারা বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রয়োজনে আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসুন।
লেখকঃ প্রকাশক-সম্পাদক
দৈনিক মুক্ত প্রভাত