
-ছবি মুক্ত প্রভাত
সাহায্য-সহযোগীতা আর ধারদেনার টাকায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে নাটোর-৩ (সিংড়া) আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এরপর আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজের নামে, স্ত্রী-শ্যালক, মাসহ বিভিন্ন আত্মীয়ের নামে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ।
২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চারটি জাতীয় নির্বাচনে দাখিল করা হলফ নামাতেই পলকের ১৪০ গুণ ও তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার নামে ১৬২ গুণ সম্পদের হিসাব দাখিল করা হয়।
পলকের দাখিল করা চারটি হলফনামা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে পলকের কাছে নগদ ৩০ হাজার এবং স্ত্রীর ছিল ৫০ হাজার টাকা। ওই নির্বাচনে ভোট করতে পলককে তার স্বজনরা ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা দান করেছিলেন।
এছাড়া ৫জনের কাছ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। সেসময় তার স্থাবর অস্থাবর মিলিয়ে ৩ লাখ ১১ হাজার টাকা স্ত্রীর স্থাবর অস্থাবর সম্পদ ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকার।
সেখান থেকে ২০১৩ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনে দাখিল করা হলফনামায় ৫ বছরে পলকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ লাখ ৪৩ হাজার এবং তার স্ত্রীর ৭৭ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৩ টাকা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় পলকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়ে ২ কোটি ৭০ লাখ এবং তার স্ত্রীর ৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা হয়।
এছাড়া সবশেষ ২০২৪ মালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় পলকের স্থাবর অস্থাবর সম্পদ বেড়ে ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা হলেও স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কিছুটা কমে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেখানো হয়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে পলকের কাছে নগদ ১ কোটি ১৭ লাখ ও তার স্ত্রীর কাছে ৪৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নগদ দেখানো হয়।
এতো গেল নির্বাচনীয় হলফনামার হিসেব। মূলত নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ব্যানারে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জুনাইদ আহমেদ পলক।
এরপর ২০১৪ সালে পলককে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৮ থেকে ২০২৪ মেয়াদে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান পলক।
সূত্র বলছে, ২০১০ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
এসব প্রকল্পের মধ্যে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক’ কর্তৃপক্ষ সারাদেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করে।
তবে এসব প্রকল্পের মধ্যে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ এই দুই অর্থবছরে হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ২৭ হাজার টাকার দুর্ণীতি খুঁজে পায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়ের নিরীক্ষা বিভাগ।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইকেট পার্ক, আইটি পার্কের মাতো বড় বড় প্রকল্পের অনিয়মের মাধ্যমে অঢেল সম্পদ গড়েছেন পলক।
এছাড়া নির্বাচনীয় এলাকায় নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছচাষ, অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন, সরকারি জায়গা দখল করে দোকান বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে চাঁদাবাজি, ডিও ব্যবসা, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যেও সক্রিয় সিন্ডিকেট ছিল পলকের।
সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নামে বেনামে শহরে গ্রামে সম্পদ গড়ছেন পলক। এরমধ্যে নির্বাচনী এলাকা নাটোরের সিংড়ায় পলকের বড় ছেলে অপূর্ব জুনাইদের নামে চওড়া মৌজার জামতলী-বামিহাল সড়ক সংলগ্ন ১৯০, ১৯১, ১৯২, ১৯৩, ১৯৮, ১৯৯, ২০০, ২০১, ২০২, ২১১, ২১৪, ২১৫, ২৯৩, ৩০৮, ৩০৯, ৩৪৪, ৫৬২ নম্বরের ১৭টি দাগে ৪২ বিঘা পুকুর ও আম বাগান কেনা হয়েছে স্থানীয় লিটলন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে।
এছাড়া পলক তার মা জামিলার নামে সুকাশ ইউনিয়নের আগমুরশন মৌজার ২০৮ নম্বর খতিয়ানভুক্ত ৭০২, ৭৯৬, ৭৯৭, ৭৯৮, ৭৯৯, ৮০০, ৮০১ নম্বরের সাতটি দাগে ১২ একর জমি কিনেছেন। ৩৬ বিঘার এই জমির পুকুর ও বাগান বিক্রি করেছেন আগমুরশন গ্রামের হেদায়েতুল্লাহ প্রামাণিক।
সূত্র বলছে, পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার নামে এবং শ্যালক লুৎফুল হাবীব রুবেলের নামে পৃথক দুটি বিলডিং রয়েছে সিংড়া পৌরসভার উপ-শহর এলাকায়। এই শহরের মাদারীপুর ও চাঁদপুর সড়ক সংলগ্ন কাটাপুকুরিয়া মৌজার ৩৫১ নম্বর দাগের ১৫ শতাংশের একটি জমি পলকের স্ত্রীর নামে কেনা হয়েছে মার্কেট নির্মাণের জন্য। এছাড়া স্ত্রী কনিকার নামে বড় মাগুড়ি এলাকায় ৫ বিঘার ভিটা, জোলারবাতা এলাকায় ১৮ বিঘার ফসলি জমি কেনা হয়েছে। অথচ পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা পেশায় স্কুলশিক্ষিকা ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে স্বামী পলকের সাথে তিনিও হয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক।
এদিকে পলক নিজের নামে জয়বাংলা মোড়ে দেড় শতাংশের জমি কিনেছেন। সেখানে পলকের দলীয় কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া সিংড়া থানা মোড় ও জোড়মল্লিকা এলাকায় শ্যালক রুবেলের নামে রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা ও গরুর খামার।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট বিমানবন্দর থেকে আটক হন সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তার আগেই বিদেশ পারি জমান পলকের পরিবারের অন্য সদস্যরা। কারাগারে থাকা পলক ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক কারাগারে থাকায় এসব অনিয়মের ব্যপারে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ফোন ধরেননি বিদেশ থাকা পলকের স্ত্রীও।
তবে সম্প্রতি একটি ইউটিউব চ্যানেলে লাইভে এসে পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা দাবি করেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়াতে বলা হচ্ছে আমি টিউশনি করে ১৮-২০টি ফ্ল্যাট করেছি। কিন্তু সেগুলো কোথায়, আমাকে দেখাক। এতো কিছুই যদি থাকতো তাহলে পলকের মামলার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হতো না। আমার বৃদ্ধ শাশুড়ি-ননদ এবং তিনটা বাচ্চার খাবারের চিন্তা এখন আমার করতে হচ্ছে।’