
চিলমারীতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।-ছবি মুক্ত প্রভাত
জামালপুর, কুড়িগ্রামের চিলমারী, বগুড়ার ধুনট এবং সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির ব্যপক অবনতি হয়েছে। এসব এলাকার ভানভাসি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল কলেজ। মুক্ত প্রভাতের সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর
ধুনট (বগুড়া): উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে নদীর কুল উপচে বাঁধের পূর্বদিকে ২ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বানভাসি এসব পরিবারের লোকজন বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ কিংবা উচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে।
শুক্রবার (৫জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদীর শহড়াবাড়ি ঘাট এলাকায় বিপৎসীমা নির্ধারন করা হয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ মিটার।
বর্তমানে পানি ১৬ দশমিক ৮৩ মিটার সমতায় প্রবাহিত হচ্ছে। পানির প্রবলস্রোতে শহড়াবাড়ি নৌঘাটের রাস্তার কিছু অংশ ভেঙে গেছে। আর নৌঘাট সহ রাস্তার অবশিষ্ট অংশ পানিতে তুলিয়ে গেছে। ফলে নৌঘাটের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এদিকে পানি বেড়ে বুধবার সকালের দিকে যমুনা নদীর কুল উপচে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের পূর্বপাশে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। বাঁধের অভ্যান্তরে প্রতিটি বাড়ির চারপাশে পানি থৈ থৈ করছে। এরমধ্যে ২শতাধিক পরিবারের বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে।
এসব পরিবারের কেউ ঘরের ভেতর মাচাং তৈরী করে বাড়িতেই অবস্থান করছেন। আবার কেউ বাড়িঘর ছেড়ে পরিবার পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছে। বানভাসি পরিবারের সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে চর এলাকার প্রায় ১০০ হেক্টর জমির আখ, পাট ও সবজি সহ বিভিন্ন জাতের ফসল।
ধুনট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল আলিম বলেন, বাঁধের পূর্বদিকের বাড়িঘরে পানি উঠতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যাদূর্গত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। বানভাসিতের তালিকা তৈরী করে প্রয়োজনীয় ত্রান সামগ্রী দেওয়া হবে।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডর (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, আগামী ২দিন পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। এরপর কমতে শুরু করবে। এ অবস্থায় পুরো বাঁধ এলাকা সার্বক্ষনিক নজদারিতে রাখা হয়েছে। আপাতত কোথাও কোন ভাঙনের শংকা নেই। এছাড়া ঝুকিপূর্ন শহড়াবাড়ি বাঁধে বালু ভর্তি জিও বস্তা ফেলে টিকে রাখার চেষ্টা চলছে।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম):
কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ৬০হাজারেরও বেশী মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।বন্যার ফলে ৪১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে। অপরদিকে তীব্র স্রোতে কয়েকদিনে অন্তত ২শতাধিক বাড়ী-ঘর ব্রহ্মপুত্র নদে বিলিন হয়ে গেছে।
জানা গেছে,উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রামে চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি শুক্রবার বিকালে চিলমারী পয়েন্টে ৭৮সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এতে মাঠে থাকা পাট,আমন বীজতলা,সবজি,তিল,তিসিসহ কৃষিজাতীয় প্রায় ২হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত অবস্থায় রয়েছে।এভাবে কিছুদিন থাকলে এসব ফসল বিনষ্ট হওয়ার আশংকা করছে চাষিরা।
হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়েছে বানভাসি মানুষ। একটু আশ্রয়ের খোঁজে বিভিন্ন উচু জায়গায় যাচ্ছে তারা। নিরুপায় হয়ে অনেকে নৌকার মধ্যে রাত্রিযাপন করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলা হলেও এখনো সবার কাছে পৌঁছেনি সরকারি সহায়তা।
সরেজমিনে উপজেলার রাণীগঞ্জ,নয়ারহাট ও রমনা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়,গত কয়েকদিন ধরে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধির ফলে গরু-ছাগল,সহায়-সম্পদ ও বৃদ্ধ-শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছে ওইসব এলাকার বানভাসি মানুষ।ঘরের ভিতর পানি প্রবেশ করায় অনেকে বাড়ী-ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা উচু জায়গায় স্থান নিয়েছে।
যাদের নৌকা আছে তারা নৌকায় আশ্রয় নিয়েছে।অনেকে ঘরের ভিতর মাচা ও চৌকি উঁচু করে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখানেই কোন রকমে রান্না করে জীবন বাচাচ্ছেন। এদিকে বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে নদের ভাঙন তীব্র আকার ধারন করেছে। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২শ পরিবার তাদের বাড়ী-ঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে।
উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের বজরাদিয়ারখাতা গ্রামের মাহফুজার রহমান,আ.রশিদ,শামছুল হক ও সাইফুল ইসলামসহ অনেকে জানান,বাড়িঘরে পানি ওঠায় গবাদি পশু ও বাচ্চাদের নিয়ে খুব বিপদে আছি। তার উপর গত দুই দিনে গ্রামের ১৭টি বাড়ী নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
ইউনিয়নটির ১নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য মো.রফিকুল ইসলাম উজ্জল বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারন জিআর এবং বন্যার্তদের জন্য সহায়তা আসলেও ইউপি চেয়ারম্যান আমার ওয়ার্ডে কাউকে তা দেননি,ফলে বন্যার্ত ওয়ার্ড বাসীকে নিয়ে বিপাকে রয়েছি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার(ভারপ্রাপ্ত)মো.জাহিদুর রহমান জানান,৪১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানি বন্দি হওয়ায় বিদ্যালয়গুলি ছুটি ঘোষনা করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.মিনহাজুল ইসলাম বলেন,বানভাসী মানুষের সাহায্যার্খে প্রাপ্ত সহায়তা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হচ্ছে।
লালমণিরহাট:
দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের পাশে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা শহর রক্ষার্থে চন্ডিমারী বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। গত বুধবার এ ধস দেখতে পায় স্থানীয়রা। দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই বাঁধ মেরামত করা না গেলে বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। এতে তিস্তা নদীর গতিপথ উল্টো দিয়ে চলে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। শুক্রবার সড়ে জমিনে গেলে এ দৃশ্য দেখা যায়।
জানা গেছে, তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড বাইপাসের পাশে সাধুর বাজার হইতে দক্ষিন দিকে হাতীবান্ধা শহর রক্ষার্থে একটি বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ওই বাঁধটি এলাকায় চন্ডিমারী বাঁধ নামে পরিচিত। সেই বাঁধে ৬০/৭০ ফিট অংশ ধসে যাচ্ছে। জিও ব্যাগ পানিতে ভেসে যাচ্ছে কয়েক দিন ধরে। পানি কমে যাওয়ার ফলে ভাঙ্গন বেড়ে গেছে কয়েক গুন।
তিস্তা পাড়ের লোকজনের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার সড়ে জমিনে পরিদর্শন করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। কিন্তু এখনো জরুরী কাজ শুরু না হওয়ার কারণে তারা আতংকিত হয়ে পড়েছে। এ বাঁধ ভেঙ্গে গেলে তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে উল্টো দিকে যাবে। এতে হাতীবান্ধা শহরে তিস্তা নদী ঢুকে পরার সম্ভবনা রয়েছে।
স্থানীয় ইউ-পি সদস্য আক্কাস আলী জানান, তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন। নির্বাহী প্রকৌশলী পরিদর্শন করেছেন। দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা ব্যারেজ ডালিয়া’র নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ দৌলা জানান, হঠাৎ করে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে জরুরী ভিত্তিতে জিও ব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ:
হু হু করে বাড়ছে সিরাজগঞ্জ যমুনা নদীর পানি। ফলে সিরাজগঞ্জ জেলার ৫টি উপজেলার কাজিপুর, চৌহালী শাহজাদপুর, এনায়েতপুর সিরাজগঞ্জ সদরে তীব্র আকারে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে।
আজ শুক্রবার বেলা ১২ টায় সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হার্ড-পয়েন্ট পানি পরিমাপক দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গত ৬ ঘণ্টায় যমুনায় পানির সমতল ১৩.৫৭ সেন্টিমিটার বেড়েছে। বর্তমানে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
অপরদিকে, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর পয়েন্টে যমুনা নদীর পানির সমতল বিপৎসীমার (১৫.২৪ মিটার) ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলার ২টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে আছে নদী পাড়ে মানুষ।
সিরাজগঞ্জে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, বন্যার পূর্বাভাস দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী যমুনায় পানির সমতল আরও কয়েকদিন বেড়ে বিপৎসীমার ৬০ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।
এদিকে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মীর মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বন্যা হলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। সিরাজগঞ্জে এখনও সেভাবে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়নি।