রমজানের শুরু থেকেই সলপের ঘোলের চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। সেই সাথে বাড়ে দামও। রোজাদার মানুষদের ইফতার সামগ্রীতে সলপের ঘোল অন্যতম।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ রেলওয়ে স্টেশনের পাশে দুই সহোদর আব্দুল মালেক ও আব্দুল খালেকের দাদা সাদেক আলী খানের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ঘোল তৈরির কারখানাগুলোতে এখন শ্রমিকেরা বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন গড়ে ১৮০ থেকে ১৯০ মন ঘোল ও মাঠা বিক্রি হচ্ছে এখানে।
স্বাদে মানে অনন্য সলপের ঘোলের চাহিদা শুধু উত্তর জনপদে নয়, গোটা দেশেই রয়েছে। ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের অন্ততঃ ৪০টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে এই ঘোল চলে যাচ্ছে।
শত বছর আগে ঘোল উৎপাদন ও ব্যবসা শুরু করেন উল্লিখিত আব্দুল মালেক ও আব্দুল খালেকের দাদা সাদেক আলী খান। প্রতিষ্ঠাকালীন সলপের জমিদারগণ এই ঘোল তৈরিতে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দেন।
সেসময়ে সলপের উৎপাদিত ঘোল ভারতের কলকাতায়ও নিয়ে যেতেনে জমিদার ও তাদের স্বজনেরা। ওই সময় সিরাজগঞ্জ থেকে রাতের বেলায় একটি ট্রেন সরাসরি কলকাতায় যেত। সেই ট্রেনেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাঠানো হতো সলপের স্বনামধন্য ঘোল।
পূর্ব পুরুষের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত এই ঘোল উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রমের অন্যতম ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক জানান, রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্য সময়ে তাদের ও তাদের স্বজনদের ঘোল উৎপাদন কারখানায় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১১০ মন ঘোল উৎপাদন ও বিক্রি হয়ে থাকে।
সেসময় প্রতি কেজি ঘোল বিক্রি হয় ৬০ টাকা এবং মাঠা (ননীযুক্ত ঘোল) বিক্রি হয় ৭০ টাকায়। কিন্তু রমজান মাস এলেই এই ঘোলের চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। সঙ্গে দামও বাড়ে।
এখন প্রতিদিনি ১৮০ থেকে ১৯০ মন ঘোল ও মাঠা বিক্রি হচ্ছে। এখন প্রতি কেজি ঘোল ৯০ টাকা থেকে ১০০ টাকা এবং মাঠা ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে আব্দুল মালেক বলেন, রমজান মাসে দুধের মূল্য বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে চিনির মূল্য বাজারে বেশি। তাছাড়া রমজানে শ্রমিকদের মজুরীও দিতে হয় বেশি। ফলে ঘোল ও মাঠার দাম বাড়াতে হয়।
আব্দুল মালেক জানান, ব্রিটিশ আমলে সলপের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় তার দাদা সাদেক আলী খান এই ঘোল উৎপাদন শুরু করেছিলেন। তার হাত থেকে বংশানুক্রমিকভাবে এখন সে এবং তার ছোট ভাই আব্দুল খালেক এই ঘোল উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
তাদের দুই ভাইয়ের হাত ধরে আরো কয়েকজন স্বজন এই ঘোলের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
তিনি জানান, তাদের ঘোলের সুখ্যাতির কারণে ২০২২ সালে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাকে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বস্তুতঃ এই পুরস্কার পাবার পর তাদের উৎপাদিত ঘোলের চাহিদা গোটা দেশেই বেড়ে যায়। এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্ততঃ ৪০টি জেলায় তাদের উৎপাদিত ঘোল বাণিজ্যিকভাবে পাঠানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মালেক।
সরেজমিনে সলপের ঘোলের কারখানা ও বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর লোকজন সেখানে ঘোল কেনার জন্য পাত্র নিয়ে ভিড় করছেন।
কথা হয় সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে আসা আশরাফুল ইসলাম, পাবনার সুজানগর থেকে আসা শাহীন আলম, নাটোর থেকে গোল কিনতে আসা আব্দুল জলিলের সঙ্গে। তারা জানান, রমজান মাসে প্রতিবছরই তারা অন্ততঃ ৩/৪ বার সলপ স্টেশনে ঘোল কিনতে আসেন।
এই ঘোলের স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। ফলে তাদের জন্য এই ঘোলের চাহিদা অনেক বেশি। অনুরুপ কথা বললেন, শাহজাদপুরের আব্দুর রহিম, চাটমোহরের শফিকুল ইসলামসহ আরো অনেকে।
কারখানায় ঘোল উৎপাদনে ব্যস্ত বেতকান্দি গ্রামের গণি জানালেন, ভালোভাবে কথা বলার সময় নেই। সময়মতো ঘোল সরবরাহ করতে না পারলে অনেক সমস্যা।
পারিশ্রমিকের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে গণি বললেন, রমজানে একটু বেশি পারিশ্রমিক পাই।
সংশিষ্ট পঞ্চক্রোশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, তাঁর (চেয়ারম্যান) দাদার আমল থেকেই তারা সলপের ঘোল খেয়ে আসছেন।
রমজান মাসে এই ঘোলের চাহিদা এ অঞ্চলের সবার কাছে বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে ঘোল কিনতে আসেন লোকজন। রমজানে ক্রেতাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।