খালের নাম তিশীখালী—খাল। চলনবিলের মাঝ দিয়ে এই খালের প্রবাহ। তিশীখালী খালের প্রবাহ বন্ধ করে মাটির বাঁধ দিয়ে দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। শুধু তিশীখালী খাল নয়— চলনবিলের পেট চিরে বয়ে যাওয়া ১৫৪ কিলোমিটার খালের বেশিরভাগ অংশই কেনা-বেচা করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
খালের সিংড়ার বিভিন্ন অংশে এখন চলছে পানি শুকিয়ে মাছ শিকার। এভাবে অসময়ে খালের পানি শুকিয়ে মাছ শিকার করায় সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষক। তিন অর্থবছরে তিশীখালী খাল এবং হুলহুলিয়া থেকে সারদানগর পর্যন্ত ৫.৯০ কিলোমিটার খালের কিছু অংশ খনন এবং পুনঃখনন করা হয়েছে। অথচ খালের পানি শুকিয়ে ফেলায় দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পাশাপাশি জীববৈচিত্র ধ্বংস করা হচ্ছে।
বেদখল হওয়া খাল রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি)। স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও খাল রক্ষার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাল রক্ষায় দৃশ্যত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
বিএডিসি সিংড়া জোনের সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) মানিক রতন বলেন, চলনবিলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ১৫৪ কিবলোমিটার খাল তার দপ্তর থেকে তিন অর্থবছরে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন করা হয়েছে। খননের পর থেকে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার করে স্বল্প ব্যায়ে সেচসুবিধা পাচ্ছিলেন কৃষক। কিন্তু খালের পেটে প্রভাবশীলের বেআইনি কার্যক্রমের ফলে এখন সেচ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় কৃষক।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (ক্ষুদ্র সেচ) সিংড়া কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, অর্থবছরে চলনবিলের সিংড়া উপজেলা অংশে ১৫৪ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হয়। এরমধ্যে হুলহুলিয়া থেকে জয়নগর বিল হয়ে সারদানগর নিয়ামত ব্রাঞ্চ পর্যন্ত খালের পাঁচ কিলোমিটার খালও রয়েছে। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় ভূ-উপরিস্থ পানির মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এটি খনন করা হয়েছিল। মূলত বর্ষায় খাল-বিল পানিতে একাকার হয়। বর্ষার শেষে বিলের পানি এসব খাল হয়েই গড়িয়ে পড়ে নদীতে। খালের এই পানিতে সেচ নির্ভর চাষাবাদও করে কৃষক।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে খাল খনন করা হয়েছে প্রভাবশালীদের দখল বাণিজ্যের কারণে তা ব্যহত হচ্ছে। কৃষকের কথা চিন্তা না করে খালের সুবিধামতো অংশ দখল করে কেনাবেচার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। খালে বাঁধ দিয়ে পানি সেচে মাছসহ জলজ প্রাণী নিধন করছেন। বাধ্য হয়ে এ অঞ্চলের প্রকৃত জেলেরাও উন্মুক্ত জলারাশিতে মাছ শিকার করতে না পেরে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে খাল কিনে মাছ শিকার করছেন।
সরকারি খাল এভাবে দখল বাণিজ্যের বিষয়টি উল্লেখ করে বিএডিসির সিংড়া জোনের সহকারী প্রকৌশলীর (ক্ষুদ্র সেচ) কার্যালয় থেকে গত ১৪ ডিসেম্বর সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও মৎস্য কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে— খালের যে ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার অংশ পুনঃখনন করা হয়েছিল, তার বেশিরভাগ অংশ বেদখল হয়ে গেছে। খালে প্রভাবশালীদের বাঁধ থাকায় হিজলী, সাতপুকুরিয়া, নদীমারী, বোয়ালমারী, পুকুরপাড়, ষষ্ঠীবিঘা, নুরপুর, কাদোগাড়ী, ডাহিয়া, মহেশচন্দ্রপুর এবং কালীনগর বিলের পানির যে সমন্বয় হওয়ার কথা ছিল, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিএডিসি বলছেÑ পুনঃখননকৃত ৫ দশমিক ৯০ কিলোমিটার খালের পানিতে এসব এলাকার প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে সেচ নির্ভর চাষাবাদ করার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি।
ডাল এবং বাঁশ ফেলে এই খালের হিজলী শ্মশান থেকে তিশীখালী মাজার হয়ে কালীনগর এলাকা পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার অংশ দখলে নিয়ে পাহারা বসিয়েছেন সিংড়ার ডাহিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী। তিনি জানান, ৬ লাখ টাকায় ইটালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কাজল খাঁর কাছ থেকে খালের এই অংশ তিনি কিনেছেন। এখন খালটি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ডাহিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী কামাল হোসেন, হিরা আলী ও রুবেল সরদার খালের অপর এক কিলোমিটার দখলে নিয়ে পানি শুকিয়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই অংশ তাঁরা সাতপুকুরিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে তিন লাখ টাকায় কিনেছেন। এদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী মজিবর সরকার ও তাঁর লোকজন তিশিখালী ডুবাব্রিজ থেকে ডাহিয়া সড়কের ডুবাব্রিজ পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার খাল ও পদ্দগাড়ী ভেলুয়ার বিল দখল করে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখানে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত মেহের আলী ও খুরশেদ আলী জানালেন, একটি মৎস্যজীবী সমিতির নামে তাঁরা খালে এই অংশ ভোগদখল করছেন।
চৌগ্রাম ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আল তৌফিক পরশ স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আলমগীর হোসেন ও বিদ্যুৎ শেখের কাছে তিশীখালি খালের দেড় কিলোমিটার অংশ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। তারাই খালের উৎস্যমুখের হুলহুলিয়া এলাকায় পানি সেঁচে মাছ শিকারের কাজ করছেন।
এছাড়া খালের সারদানগর অংশ আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক, আজাদুল, হারিছ ও ভুলু মিয়ার কাছে ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন ওই নেতা।
তিশীখালি খাল বিক্রির কথা স্বীকার করে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আল তৌফিক পরশ মোবাইল ফোনে বলেন, তিনি খাল বিক্রি করেছে ঠিকইÑতবে টাকা ব্যবহার হচ্ছেছ গ্রামের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে।
কৃষকদের অভিযোগ, চলনবিলের ফসলি জমি সেচের জন্য খালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাষাবাদের ক্ষেত্রে আশপাশের কয়েক হাজার কৃষক এই খালের ওপর নির্ভরশীল। অথচ সেচ মওসুম শুরুর আগেই প্রভাবশালীরা পানি সেঁচে মাছ শিকার করায় চাষাবাদ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন কয়েক হাজার কৃষক।
সিংড়ার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন বলেন, মৎস্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষা আইনে সরকারি খাল দখল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তারা খোঁজ নিয়ে খাল বিক্রির ব্যপারে ব্যবস্থা নেবেন।
সিংড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা খাতুন বলেন, খাল বিক্রির বিষয়টি তিনি জানেনা। অভিযোগ পেলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।