বাবুরচি না থাকায় রা্ন্না করছ শিশুরা- ছবি মুক্ত প্রভাত
ঝালকাঠি সরকারি শিশু পারিবারে সমাজ সেবা কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারের মধ্যে বরাদ্দ নিয়ে মতোবিরোধে চরম অব্যাবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এতে শিশুরা তালিকার খাবার না পেলেও মুখ খুলতে সাহষ পাচ্ছেনা। ঠিকাদার বলছে বরাদ্দ অপ্রতুল, ধার করে খাবার সরবরাহ করতে হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছে বরাদ্দ কম হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা।
টেন্ডারে ঠিকাদারের নির্ধারিত দরেই তিনি তালিকার খাবার সরবরাহ করবেন। এদিকে একই ঠিকাদরকে দীর্ঘদিন এখানে সুযোগ দেয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে কোন স্বার্থ আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই এই পরিবারে পরিত্যাক্ত এবং এতিম শিশুদের নিম্নমানের সবজি খেয়ে কাটাতে হচ্ছে প্রায়দিন।
ঝালকাঠি ৪ উপজেলার এতিম ও পরিত্যাক্ত শিশুদের নিয়ে ১৯৯৯ সনে নির্মিত আবাসিক ভবনে গড়ে তোলা হয় শিশু পরিবার। এদের থাকা, খাওয়া, খেলাধুলা, পড়াশুনা সবকিছু সরকারি বরাদ্দে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু সাংবাদিকরা এলেই কর্তৃপক্ষের বাঁধার সম্মুখিন হতে হয়।
অনুমতি ছাড়া এখানে প্রবেশ করা, কথা বলা, ছবি তোলা নিষেধ বলে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। বাবুর্চির অনুপস্থিতিতে শিশুরা নিজেদের রান্না নিজেরাই করছে। এক কথায় এখানকার সার্বিক কার্যক্রম একটি ধুম্রজালে ঘেরা।
*১৫ বছরে একই ঠিকাদার সর্বনিম্ন দরদাতা-
*বাবুর্চীর অনুপস্থিতিতে রান্না করে শিশুরা-
একশ শিশু বসবাসের এ ভবনে কাগজে কলমে ৭০ জন দেখানো হলেও বাস্তবে কম থাকে। ভবনটি সংস্কারের নামে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও সংস্কার কাজের নেই কোন নমুনা। আবার একই ভাবে খাবার পড়াশুনা ও খেলাধূলার জন্য প্রাপ্ত বরাদ্দ অপ্রতুল বলে খাওয়ানো হচ্ছে সস্তা সবজি। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের পরিচালিত শিশু পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত স্টাফ ১৫/২০ বছর ধরে এখানে থাকছে। এসব বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গেলে বাঁধার সম্মুখিন হয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।
ঝালকাঠি সরকারী শিশু পরিবার ভবন ঝুঁকিপুর্ণ- ছবি মুক্ত প্রভাত
শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, এখানকার ১টি শিশুর জন্য মাসিক বরাদ্দ ৪ হাজার টাকা। এরমধ্যে ৩ হাজার ৫শ টাকা খাদ্য ও জ্বালানি খাতে এবং ৫শ টাকা শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ। এতে শিশুদের মাছ, মুরগির মাংশ, ডিম ও দুধ খাওয়ানোর কথা জানালেও ঠিকাদার বলছে এটা অসম্ভব।
তাই প্রশ্ন উঠেছে কর্তৃপক্ষের এ কথার সাথে ঠিকাদারের বিরোধীতা কি যুক্তি সংগত নাকি আই ওয়াস। তাহলে কর্তৃপক্ষ নিরব না থেকে এই বরাদ্দে খাবার সরবরাহের নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করছেনা কেন এমন প্রশ্ন তুলেছেন জেলা সুজন সাধারন সম্পাদক মঈন তালুকদার।
গত ১৩ জুলাই বেলা ১২ টায় শিশু পরিবারে গেলে প্রথমেই বাঁধা দেন প্রশিক্ষক আসমা বেগম। খাবার খাওয়া অবস্থায় এক শিশুর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি তাতে বাঁধা দেন। ক্যামেরার সামনে থেকে শিশুটিকে সরিয়ে নিয়ে যান। ভিডিও করতে বাঁধা দিয়ে কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন প্রশিক্ষক।
এতিম শিশুরা খেলাধুলায়- ছবি মুক্ত প্রভাত
জানাযায় এই আসমা বেগম ২০১৫ সন থেকে এখানে প্রশিক্ষক হিসাবে কর্মরত। তবে তিনি কিসের প্রশিক্ষক জানতে চাইলে কোন জবাব না দিয়ে নিরব থাকেন। ভিডিও করতে এবং শিশুদের সাথে কথা বলতে বাঁধা দিলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন নিষেধ আছে। কার নিষেধ জানতে চাইলে বলেন কর্মকর্তার কথা। ঐ দিন দুপুরে তিনি বলেন মুরগীর মাংস দিয়ে খিচুরি রান্না হয়েছে।
কিন্তু খবার রুমে গিয়ে দেখা যায় ডাইলে চাউলে খিচুরি থাকলেও তাতে এক টুকরো মাংস দেখাতে পারেনি বাবুর্চি। এরপর দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ তলায় গিয়ে শিশুদের সাথে কথা বলতে চাইলে তারা দরজা ও খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ে। কারণ সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার অপরাধে পরে শাস্তি খাটতে হবে জেনেই পালানো ছাড়া উপায় ছিলনা। এদিন সকালে তারা কি খেয়েছে জানতে চাইলে কিছু না বললেও বাবুর্চি জানিয়েছে আলু ভাজি ও ভাত।
১৩ জুলাই এখানে যাবার পর খবর দিয়ে আনা হয় শিশু পরিবারের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-তত্তাবধায়ক খান জসিম উদ্দিন এবং বড় ভাই পদের দায়িত্বে থাকা জসিম উদ্দিনকে। তারা এসে শিশুদের সাথে রুমে বসে কথা না বলে তাদের অফিস রুমে আসতে অনুরোধ জানান। সেখানে যাবার পর তারা জানান, গত অর্থ বছর থেকে ৫শত টাকা বাড়িয়ে বরাদ্দ ৪ হাজার টাকা করা হয়।
এ হিসাবে মোট বরাদ্দের পরিমান ৪ হাজার টাকা হলেও তথ্য বোর্ডে ৩ হাজার ৫০০ টাকা লিখে রাখার কারণ সম্পর্কে তারা কিছুই জানাতে পারেনি। এসময় তাদের সামনে শিশু শিক্ষার্থী গোলাম রাব্বি (১০) জানায় সকালে আলু ভাজি ভাত দেয়া হয়েছে। অপর শিশু সুজন ও রাতুল জানায় কোরবানীর দিন ছাড়া গরুর মাংস খেতে পায়না। কুমড়া, লাউ, আলু তরকারি বেশি দেয়া হয়। মাছ মাংস মাঝে মাঝে দিলেও পরিমানে খুবই সামান্য।
খাবার মেনুর তলিকায় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ থাকলেও সবজি খেয়েই এদের কাটাতে হচ্ছে বেশির ভাগ দিন। গত ১১ জুলাই শিশু পরিবারে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলে এটুকু বোঝা যায় প্রায় দিনই সস্তা শবজী দিয়ে খেতে হচ্ছে তাদের। ঝালকাঠি সদরের বাসন্ডা ইউনিয়নের এক শিশু শিক্ষার্থী জানায়, ১০ জুলাই রাতে এবং সকালে কুমড়া আর ভাত খেয়েছে তারা।
ধসে পরছে ভবনের দেওয়ালের প্লাস্টার- ছবি মুক্ত প্রভাত
আবার ১১ জুলাই বেলা ১২ টার দিকে গিয়ে দেখা যায় দুপুরের জন্য রান্না করা হয়েছে শুধু আলু তরকারি। এদিন বাবুর্চি দুপুরে ডিমের কথা জানালেও সেখানে ডিম ছিল না। বাবুর্চি মো. মিঠু জানান, তাকে রান্নার কাজে সহায়তা করে শিশুরাই। বড় ভাই জসিম উদ্দিন বলেন, সরকার যে ভাবে যা বরাদ্দ দেন সে ভাবে ম্যানেজ করে খাওয়ানো হয়। তবে সবজি প্রতিদিন দেয়ার কথা তিনি স্বিকার করেন।
সরকারি এ শিশু পরিবারের ৪ তলা ভবনটিও মারাত্মক ঝুকিতে রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়। রড ছাড়া সম্পূর্ন ইটের গাথুনির উপর দাড়িয়ে আছে দীর্ঘ দিনের ভবনটি। এ বিষয়ে ৪ তলার ২ নং রুমের শিশুদের সাথে কথা বলে জানাযায়, অহরহ বালু ও পলেস্তারা খসে পড়ায় তারা আতংকে আছে। নষ্ট হচ্ছে তাদের জামা কাপুড় এবং বিছানা। কর্তৃপক্ষ বলছে ঝুকিপূর্ন এ ভবনটি নিয়ে আমরাও আছি দুশ্চিন্তায়।
তবে শিশু পরিবারের বড় ভাই পদের দায়িত্বে থাকা মো. জসিম উদ্দিন জানান, গত ৭ বছরে মোট প্রায় ২০ লাখ টাকা সংস্কার খাতে বরাদ্দ এলেও এ টাকায় কিছুই হয়না। তাই এখন পলেস্তারা খসে পড়ে বসবাসের জন্য ঝুকি হয়ে পরেছে ভবনটি।
প্রাপ্ত বরাদ্দে শিশুদের খাবার বিষয়ে ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি লোকসান দিয়ে শিশু সদনে খাবার সরবরাহ করছি। কারণ আমি যে দরে এখানে খাবার সরবরাহের কাজ পেয়েছি বাজার দর তার চেয়ে বেশি। এতে আমার ২৫/৩০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতি মাসে। আমি এবার টেন্ডার দিতে না চাইলেও কর্তৃপক্ষের অনুরোধে দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ বলছে প্রাপ্ত বরাদ্দে মাছ, মাংস ডিম, দুধ, সবজি সব পাচ্ছে এখানকার শিশুরা। আপনি বলছেন প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে তালিকার খাবার সম্ভব নয় তাহলে ওরা কি খাচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ধার করে খাওয়াচ্ছি।
সর্বশেষ গত ১৬ জুলাই শিশু পরিবারের রান্না ঘরে গিয়ে দেখা যায় শিশুরাই রান্না ধোয়া কাটাকাটির কাজ করছে। রান্নার কাজে ব্যাস্ত শিক্ষার্থী মো. মুসা জানান বাবুর্চি আজকের ছুটিতে থাকায় আমরাই আমাদের খাবার তৈরী করছি। আজ মাছ, ডাইল, আলু ও সবজি রান্না হচ্ছে ৬০ জনের জন্য। কিন্তু বড় ভাইয়ের দায়িত্বে থাকা জসিম উদ্দিন জানান এদিন উপস্থিত শিশুর সংখ্যা ৭০ জন।
এ সময় তার কাছে হাজিরা খাতায় কত জন উপস্থিত জানতে চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি। তিনি জানান জুন জুলাই মাসে খাতায় হাজিরা এখন পর্যন্ত তোলা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জেলা সমাজ সেবা উপ-পরিচালক শাহপার পারভিনের কাছে ২০০৮ সন থেকে কি ভাবে একই ঠিকাদর খাবার সরবরাহ করছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এখানে ওটিএম পদ্ধতিতে টেন্ডার আহব্বান করা হয়। সবশেষ টেন্ডারে ৩/৪ জন অংশ নিয়েছে। তাদের মধ্যে বর্তমান ঠিকাদার সর্বনিম্ন করদাতা নির্বাচিত হয়েছে। ১৫ বছর ধরে একই ঠিকাদার সর্বনি¤œদর দাতার বিষয়টি রহস্যজনক কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এখানে ২০২১ সনে এসেছি।
এর আগের সময়ের কথা বলতে পারবনা। টেন্ডারে অপর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফাইল না দেখে বলা যাবেনা। শিশু পরিবারে কর্মরত একই স্টাফদের দীর্ঘ সময়ে এখানে রাখার বিষয়ে তিনি বলে এটা অধিদপ্তরের বিষয়। ষ্টাফরা এখানে কেন সাংবাদিকদের প্রবেশে এবং শিশুদের সাথে কথা বলতে বাঁধা দেয় জানতে চাইলে তিনি দেখবেন বলে জানান। খাবারের জন্য বরাদ্দ যথেষ্ট কিনা নাকি অপ্রতুল এ বিষয়ে বলেন, তালিকা অনুযায়ি এটা যথেষ্ট।
এ সময় তিনি উল্লেখ করেন ২০২২ সনের ১৬ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তরের এক আদেশে জনপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকার বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। ঠিকাদারের লস দিয়ে খাবার সরবরাহ করার প্রশ্নই উঠেনা। খাতায় শিশুদের হাজিরা প্রতিদিন না নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা হওয়ার কথা না। এ বিষয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভবনটি সংস্কারের জন্য বার্ষিক বরাদ্দের টাকায় কাজ করা হয় জানিয়ে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ন হওয়ায় গণপূর্ত বিভাগকে এটা সার্ভে করিয়ে রিপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।