৪ জুলাই, ২০২৩

সুগন্ধায় জাহাজে বিস্ফোরণ: ফিটনেস যাচাইয়ে ৪ তদন্ত কমিটি

সুগন্ধায় জাহাজে বিস্ফোরণ: ফিটনেস যাচাইয়ে ৪ তদন্ত কমিটি

ভোলায় সাগর নন্দিনী-২ জাহাজটি নদীতে ডুবে জাবার পর এটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়। এরপর আবার এর ফিটনেস ঠিক করে এটি চলাচলের উপযুক্ত হয়েছে কিনা এবং বৈধ কাগজ পত্র আছে কিনা তা ক্ষতিয়ে দেখবে জ্বালানী মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি।

এদিকে বিস্ফোরনের পর তলা থেকে পানি প্রবেশ করে পরিত্যাক্ত জ্বালানীর সাথে ওজন বেড়ে যাওয়ায় জাহাজটি ক্রমশ দেবে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ দূষন হবার শংকা দেখা দিয়েছে নদী পাড়ের মানুষের মাঝে। 
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে সাগর নন্দিনী-২ জ্বালানী তেল বহনকারী জাহাজে দ্বিতীয় বিস্ফোরনের ঘটনায় রাতভর জ্বলছিলো আগুন।

রাত ৯ টায় বরিশাল নৌ ফায়ার সার্ভিসের অগ্নীযোদ্ধা জাহাজ এসে মঙ্গলবার ভোর ৫ টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনে। এদিকে বিস্ফোরিত জাহাজটির ভিতরে জালানির সাথে পানি প্রবেশ করে মিশে যাচ্ছে। এতে একদিকে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ অন্য দিকে জাহাজটি পানির নিচে দেবে যাচ্ছে।

এ ঘটনায় জালানী ও ক্ষনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে এ কমিটি প্রতিবেদন দিবে বলে জানিয়েছেন জালানী সচিব ড. মোঃ খায়রুজ্জামান। এই ঘটনায় মোট ৪ টি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

তিনি মঙ্গলবার ঝালকাঠি এসে সুগন্ধা নদীতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে এ কথা জানান। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেজ) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং বরিশাল নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার মো. কফিল উদ্দিন সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করেন। 

ডিপো সুত্রে জানা যায়, সাগর নন্দিনী জাহাজ কোম্পানীর মালিক সরকার দলীয় এক প্রভাবশালী নেতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে জাহাজের লোকজন ডিপো কর্তৃপক্ষের কোন নির্দেশনা মানতে চাননা। তোয়াক্কা করেনা ডিপো কর্তৃপক্ষে কোন বিধি নিষেধ।

সুত্র জানায় এই কারনে ঝালকাঠিতে এই কোম্পানীর জাহাজে জালানী নিয়ে আসার পর তাদের ইচ্ছা মাফিক কাজের ব্যাপারে কেউ কথা বলেতে সাহষ পায়না। তাই ২০২১ সালে সাগর নন্দিনী-৩ সুগন্ধা নদীর একই স্থানে অনুরুপ দূর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে দ্বিতীয় বিস্ফোরনের কারন অনুসন্ধান ও ডিপো সুত্রে জানাযায়, বিস্ফোরিত জাহাজটি থেকে অপর জাহাজে জালানী অপসারণে ডিপো কর্তৃপক্ষ একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মালিক পক্ষকে অনুরোধ জানায়। দুপুরের দিকে ডিপো কর্তৃপক্ষ এই কথা জানিয়ে জাহাজ থেকে ফিরে আসে। কিন্তু এর গুরুত্ব না দিয়ে জাহাজ কর্তৃপক্ষ অন্য প্রক্রিয়ায় বিকেলে তেল অপসারণের কাজ শুরু করে।

সুগন্ধা নদীতে জাহাজ বিস্ফোরণের পর পানি প্রবেশ করছে জাহাজে- ছবি মুক্ত প্রভাত 


যদিও এই কাজ ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় জালানী অপসারণ বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়ে ছিল। জাহাজ থেকে ফিরে আসা ডিপো কর্তৃপক্ষের একটি সুত্র জানায়, তাদের না জানিয়ে এই তেল অপসারণে “সাবমারসিবল” পাম্প ব্যাবহার করায় স্পার্কিংয়ের মাধ্যমে এ বিস্ফোরনের ঘটনা ঘটতে পারে। সুত্র থেকে প্রাপ্ত এই তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে জালানী সচিব বরাবরে ট্যাংকার ওটি সাগর নন্দিনী-২ এ অগ্নি দূর্ঘটনা প্রসঙ্গের একটি লিখিত অবহিত পত্রে। পদ্মা অয়েল কোম্পানীর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মাসুদুর রহমান স্বাক্ষরিত।

এতে উল্লেখ করা হয় ওটি মৃদুলা-৫ ট্যাংকারে আনুমানিক ২ লাখ ২৫ হাজার লিটার ডিজেল বোঝাই করে মালিকরে সাগর নন্দিনী-৪ ট্যাংকারে সআন্তর করা হয়। ওটি সেভেন সিমাক -২ ট্যাংকারের মাধ্যমে ৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৮ লিটার ডিজেল পদ্মা ডিপোর ট্যাংকে গ্রহন করা হয়। ২ জুলাই অবশিষ্ট পেট্রোল খালাসের উদ্যোগ নেয়া হয়। জাহাজ কর্তৃপক্ষের খালাশ কার্যক্রম নিরাপদ মনে না করায় পদ্মা অয়েল কোম্পানী কর্তৃপক্ষ কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে ঝালকাঠি ডিপোতে ফিরে আসে।

সাগর নন্দিনী-২ থেকে সাগর নন্দিনী-৪ ট্যাংকারে পেট্রোল স্থানান্তরের জন্য ডিপোর ভিতরে পাম্প এবং অন্যান্য ফিটিংস তৈরীর জন্য প্রস্তুতি চলছিল। ইতিমধ্যে ৩ জুলাই হঠাৎ বিকাল আনুমানিক সারে ৬ টার দিকে বিকট সব্দে আবারো ওটি সাগর নন্দিনী-২ ট্যাংকারে আগুন লেগে যায়। দ্বিতীয় দফায় এই দূর্ঘটনায় জাহাজের ৪ জন এবং পুলিশের ১০ জন সদস্য আহত হয়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেনেজ) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধূরী গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জাহাজ থেকে তেল অপসারণের বিষয়ে কিছু ত্রæটির কারনে এই দূর্ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে অধিকতর সতর্কতা মূলক ব্যাবস্থা না নেয়ায় মালিক পক্ষই দায়ী। এধরনের আগুন নিয়ন্ত্রনে ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের পর্যাপ্ত ফোম না থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে সময় লেগেছে। তবে বিষ্ফোরিত জাহাজটির সাথেই নোঙর করে রাখা সাগর নন্দিনি-৪ নামক আরেকটি জাহাজকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।

ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বিস্ফোরণের পর আগুন নিয়ন্ত্রনের বিষয়ে বলেন, সাগর নন্দিনী-২ জাহাজে বিকেলে দ্বিতীয় বিস্ফোরনের পর বরিশাল বিভাগের ফায়ার সার্ভিস অগ্নীযোদ্ধা জাহাজ নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে। রাতে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করার কিছুক্ষন পর ফোম শেষ হয়ে যায়। তাই খুলনা থেকে পাঠানো ১০৫ কন্টিনার ফোম রাত ৩ টায় ঝালকাঠিতে আনা হয়। প্রায় ১০ ঘন্টা আগুন জ্বলার পর ভোর ৫ টার দিকে জাহাজটির আগুন নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হয়।

বরিশাল নৌ পুলিশের পুলিশ সুপার মো. কফিল উদ্দিন বলেন, এই ঘটনায় আমাদের ৯ জন পুলিশ আহত হয়ে ঝালকাঠি বরিশালে চিকিৎসাধীন আছে। তার মধ্যে ২ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাদের ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বার বার এধরনের নৌ দুর্ঘটনা ঘটায় জাহাজ মালিকদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ নৌ পুলিসের।'

ঝালকাঠিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা জালানী ও ক্ষনিজ সচিব ড. মোঃ খায়রুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, দক্ষিনাঞ্চলের গুরত্বপূর্ন নৌরুটের পাশপাশি ঝালকাঠিতে যেহেতু বিভিন্ন তেল কোম্পানীর ডিপো রয়েছে তাই এখানে একটি নৌ ফায়ার স্টেশন নির্মান করা যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি আমার মন্ত্রনালয়ের না হওয়ায় এ বিষয়ে সুপারিশ করা হবে। আমাদের ধারনা জাহাজে থাকা অধিকাংশ জালানি বিস্ফোরণের পর নষ্ট হয়ে গেছে।

আমার আসার মূল উদ্দেশ্য এই মূহুর্তে জাহাজটিতে থাকা ব্যাবহারে অযোগ্য জালানি কিভাবে সরিয়ে নেয়া এবং অপর জাহাজে স্থানান্তর করা জালানী কিভাবে পূনরায় দূর্ঘটনা ছাড়া ডিপোতে স্থানান্তর করা যায়। এই ঘটনার বিষয়ে প্রথম জেলা প্রশাসন ও পদ্মা ওয়েল কোম্পানী পৃথক দুটি, পরে দ্বিতীয় দফা বিস্ফোরনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস এবং আমাদের মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে আরো ২ টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রনারয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান হবেন আমাদের মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম সচিব বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ডিজি।

ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সেই জন্য তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর কাজ শুরু করা হবে। ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে এ কমিটি তার প্রতিবেদন দিবে। ভোলায় সাগর নন্দিনী-২ জাহাজটি নদীতে ডুবে জাবার পর এটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষনা করা হয়। এরপর আবার এর ফিটনেস ঠিক করে এটি চলাচলে উপযুক্ত হয়েছে কিনা এবং বৈধ কাগজ পত্র পেয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, এ বিষয়টি তদন্তে খতিয়ে দেখা হবে।

ঘটনার পর পরিবেশের উপর কোন প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এ,এইচ, এম রাসেদ বলেন, পানির সাথে যদি এই জালানী মিশে যায় তা হলে জীব বৈচীত্র হুমকির মুখে পড়বে। এবং গাছের শিকড়ের সাথে এই জ্বালানী আটকে গাছ পালার উপরেও বিরুপ প্রভাব পড়বে। তবে আমি ঘটনা স্থলে গিয়ে আরো বিস্তারিত যানাতে পারবো।

উল্লেখ্য, পহেলা জুন শনিবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পদ্মা অয়েল কোম্পানির জ্বালানি তেলবাহী ট্যংকার ‘ওটি সাগর নন্দিনী-২’ বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে যায়। দুর্ঘটনায় জাহাজের পেছনের তিনতলা বিশিষ্ট চালকের কক্ষ ও কেবিনের অংশ উড়ে গিয়ে পানিতে নিমজ্জিত হয়। এতে ৪ জন নিহত এবং ৫ জন আহত হয়।