বাড়ির উঠনে ডুকরে কাঁদছিলেন বৃদ্ধা আলেকজান বিবি। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন- ‘শ্বশুর বাড়ি ঘুরে দুইদিন পরই আমার বুকের ধন বুকে আসার কথা। ছেলে আনোয়ার বুধবার ভোড়ে বাড়ি এলো, তবে লাশ হয়ে!’ এভাবে বিলাপ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে মূর্ছাও যাচ্ছেন তিনি।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে আনোয়ারের সঙ্গে আনা হয়েছে তার দুই বছরের মেয়ে আন্নি ও স্ত্রী আঁখি খাতুনের নিথর দেহও। গুরুদাসপুরের নাজিরপুর ইউনিয়নের মকিমপুর কবরস্থানে বুধবার সকাল দশটার দিকে তাদের তিনজনকে দাফন করা হয়েছে। আনোয়ার এই গ্রামের খলিলুর রহমানের মেঝো ছেলে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার পথে গাজিপুরের চৌরাস্তার উত্তর পাশে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে তারা মারা যান মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে।
নিহত আনোয়ারের পিতা খলিলুর রহমান ছেলে, নাতনি আর পূত্রবধূকে দাফন করে বাড়ির বাড়ান্দায় বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, সবশেষ সোমবার দিবাগত রাতে ছেলে ফোন করে পরিবারের লোকজনের খবর নিয়েছিলেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুইদিন পরই বাড়ি আসার কথা ছিল আনোয়ারের।
তিনি বলেন, সে দিন মোবাইল ফোনে নাতনি আন্নি বলছিল ‘দাদু তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি নানু বাড়ি থেকে ঘুরে তোমার কাছে আসবো, তুমি মন খারাপ করোনা।’ নাতনির এমন মায়াভড়া কথাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তিনি। নিহতদের জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আনোয়ারের আপন চাচা মেহেরুল ইসলাম বলেন, আনোয়ার আরএফএল কোম্পানিতে ময়মনসিংহ এলাকায় চাকরি করতেন। সেখানেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটি অটোরিক্সায় চড়ে মঙ্গলবার সকালে শ্বশুড়বাড়ি আশুলিয়ার তৌহিদপুর এলাকায় যাচ্ছিলেন। কিন্তু গাজিপুরের চৌরাস্তার উত্তরপাশে পৌঁছলে বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক আনোয়ারকে স্বপরিবারে চাপা দেয়। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছোট্ট শিশু আন্নি। হাসপাতালে নেওয়ার সময় মারা যান আঁখি। গাজিপুর সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পথে মারা যান আনোয়ারও।
নিহত আঁখির চাচা আব্দুল আলিম বলেন, আনোয়ারের মোবাইল ফোন থেকে কল করে দুর্ঘটনার কথা জানান স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থল থেকে লাশ নিয়ে আশুলিয়াতে শেষ গোসল করানো হয়। রাতেই লাশের সঙ্গে তারাও গুরুদাসপুরে আসেন। তিনি বলেন, আনোয়ার ও আখিঁর মধ্যে স্বা-স্ত্রী হিসেবে দারুণ সম্পর্ক ছিল। ছোট্ট শিশু আন্নিও ছিল তাদের চোখের মণি। একসঙ্গে পরিবারের তিন সদস্যের মৃত্যু তারা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না।
স্থানীয় লোকজন বলেন, মৃত্যুর খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার পর আনোয়ারদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ও উৎসুখ মানুষের ভিড় জমে। পরিবারের লোকজনের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে গ্রামের আকাশ-বাতাশ। বুধবার সকালে জানাজায় অংশ নেন বহু মানুষ। এ সময় নাটোর জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আজিজও জানাজায় অংশ নেন।