১৬ মার্চ, ২০২৫

প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি, সাতক্ষীরা ভোমরা সীমান্তে বেপরোয়া মাদক চোরাচালান চক্র

প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি, সাতক্ষীরা ভোমরা সীমান্তে বেপরোয়া মাদক চোরাচালান চক্র

সাতক্ষীরার সীমান্ত জুড়ে মাদক চোরাকারবার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা একাধিক সংঘবদ্ধ শক্তিশালী মাদক চোরাচালান চক্র।

তারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি'র কিছু অসাধু সদস্যদের অনৈতিক সহায়তায় এই মাদকে কারবার চালিয়ে আসছে বলে জানাগেছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামিলীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগকরে ভারতে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত দু'দেশই তাদের সীমান্তে রেডএলার্ট জারিকরে।

বিজিবি-বিএসএফ এর কড়া নজরদারি থাকতেই প্রতিদিন সাতক্ষীরার বিভিন্ন সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে ভারত থেকে আসছে শত শত কোটি টাকার ভয়ংকর সব মাদক। বিনিময়ে সেই পথধরেই ভারতে যাচ্ছে স্বর্ণের চালান। সবচেয়ে বেশি মাদক আসছে সাতক্ষীরা সদরের ভোমরার হাড়তদ্দহ, লক্ষিদাড়ী ২ নং, ঘোষপাড়া ও ঘোনা গাজীপুর সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে। এসব এলাকাদিয়ে সন্ধা নামার সাথে সাথেই শুরুহয় মাদক পারাপারের তোড়জোড়।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সাতক্ষীরা জেলায় সবচেয়ে বেশি মাদকের চোরাকারবার চলছে ভোমরা সীমান্তে। ভোমরা সীমান্তের অলিগলিতে হাত বাড়ালেই মিলছে ভয়ংকর সব মাদক। এই মাহেরমজানেও প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি ও সেবন করতে দেখাযায় চিহ্নিত স্পষ্ট গুলোতে। এই ভোমরা সীমান্তেই গড়ে উঠেছে ৩০টির মত সংঘবদ্ধ শক্তিশালী মাদক চোরাচালান চক্র।

দীর্ঘ তথ্য অনুসন্ধানে জানাগেছে ভোমরা সীমান্তে চিহ্নিত মাদক চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্যরা হলো, জেলার শীর্ষ মাদক চোরাকারবারি ভোমরা ইউনিয়নের শ্রীরামপুর এলাকায় আরশাদ আলী ওরফে ভদু। ভদু’র পরিবারের সব সদস্য এক ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাই এরা সবাই পেশাদার মাদক চোরাকারবারি। ভদু একাধিক মাদক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পুলিশের ভয়ে ৮ বছর ভারতে পালিয়ে থাকার পর গত তিন বছর আগে ফিরে এসেছে সাতক্ষীরায়।

ভদু ও তার ছেলে শামিম, মেয়ে লিপি খাতুন, পাপিয়া খাতুন, জামাই মাস্টার ওরফে হালিম মাস্টার এদের সবারই পৃথক মাদকের ব্যবসা রয়েছে। এদের মধ্যে আব্দুল হালিম ওরফে মাস্টার হালিম তার স্ত্রী পাপিয়া খাতুন ভোমরা টাওয়ার মোড়ে বসবাস করলেও পুরো সীমান্ত জুড়ে রয়েছে মাস্টার হালিম ও তার স্ত্রী পাপিয়ার মাদকের নেটওয়ার্ক।

পাপিয়া খাতুন নিজ বাড়িতে বসে মাদকের পাইকারি ও খুচরা ব্যাবসা করে। হালিম মাস্টার নিজে টাওয়ার মোড়ে বসে দু'জন সহকারী দিয়ে মাদকের রমরমা ব্যাবসা পরিচালনা করে। এছাড়া ভদু’র ছেলে শামিম সীমান্ত এলাকায় ফেনন্সিডিলের ডিলার। ভোমরা এলাকার সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়ী শামিম। ভোমরা গয়েষপুর এলাকায় নিজ বিলাসবহুল বাড়িতে বসে কয়েক জন সহযোগী রেখে খুচরা ও পাইকারি ফেনন্সিডিল ও সব ধরনের মাদকের চোরাকারবার করে তিনি।

শামিম পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কয়েক জন সদস্যসের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রেখে সাতক্ষীরা জেলাসহ ঢাকা, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক চোরাচালান করে আসছে। শামিম মামলা হামলা এড়াতে বিগত আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ছত্রছায়ায় চোরাকারবার চালিয়ে আসলেও এখন অবৈধ অর্থের প্রভাবে চোরাকারবার চালাচ্ছে।

এছাড়া মাস্টার হালিম এর নামে ৮টি মাদকের মামলা রয়েছে ও স্ত্রী পাপিয়ার নামেও মামলা রয়েছে। মাদকের রমরমা ব্যাবসা করে তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। কিনেছে বিঘা বিঘা জমি। গড়েছে টাইলস বাধানো বাড়ি।

এছাড়া মাদকের বেপরোয়া চোরাকারবার করে আসছে মাহমুদপুর গোয়ালপাড়া এলাকার হাসান সরদারের ছেলে ইসরাফিল সরদার। ইসরাফিল ফেনন্সিডিল, অস্ত্র ও স্বর্ণের জেলার শীর্ষ চোরাকারবারি। তার চালানে আসে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল। মদ,গাঁজা, ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক ও অস্ত্র গুলি। সে এসব চালানের বিপরীতে ভারতীয় পাটিকে স্বর্ণ দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে।

ভোমরা সীমান্তের অন্যান্য মাদক চোরাকারবারিরা হলেন মাহমুদপুর নাটাপাড়া এলাকার গাঁজা ব্যবসায়ী আবু তালেব এর ছেলে ফেনসিডিল ব্যাবসায়ী তুহিন, মাহমুদপুর গাঙ্গানিয়ার বশির কারিগরের ছেলে আজিজুল ইসলাম পলতা, মাহমুদপুর নাটাপাড়া এলাকার সাইদুল, মাহমুদপুর এলাকার হান্নান, গয়েষপুর এলাকার চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারি মৃত ছলে সরদারের ছেলে ফারুক, ভোমরা হাড়হদ্দ এলাকার পল্টি রমজান, শ্রীরামপুর এলাকার হাসান, বকুল এরা সবাই চিহ্নিত প্রভাবশালী সঙ্ঘবদ্ধ মাদক চোরাকারবারি।

তারা সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় মাদকের শক্তিশালী চক্র গড়ে তুলেছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে তারা রাতের অন্ধকারে সদরের গাজীপুর সীমান্ত, ভোমরা, হাড়হদ্দ ও ঘোনা সীমান্তের বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল, মদ, এলএসডি, ইয়াবা, গাঁজাসহ  বিভিন্ন ধরনের মাদক আমদানি করে আসছে বহুদিন ধরে।

এদের মধ্যে আজিজুল ইসলাম পলতার নামে রয়েছে একাধিক মাদকের মামলা। বাদামতলা ও গয়েষপুর এলাকায় বেপরোয়া ভাবে মাদকের চোরাকারবার চালিয়ে আসছে পুলিশের সোর্স পরিচয় দানকারী ফারুক। এই ফারুক ইয়াবা ও ফেনসিডিল এর পাইকারি বিক্রেতা। ফারুকের নামে রয়েছে আটটি মাদকের মামলা।

দেশে পালাবদলের এ’সময়ে অন্তবর্তী সরকারের পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলো জেলা জুড়ে বৃদ্ধি পাওয়া মাদক চোরাকারবার নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হচ্ছে। সাথে সাথে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও পতিত আওয়ামী সরকারের আমলের মতো নিজেদের মাদক চোরাকারবারিদের সাথে অবৈধ চুক্তি ও সখ্যতা রেখে নামমাত্র অভিযান করে টিকে রয়েছে। বিজিবি,  সদর থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের একাধিক সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে তারা এই মাদকের চোরাকারবার চালিয়ে আসছে চক্রগুলো।

ভোমরা ইউনিয়নের একাধিক ব্যক্তি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দিন দিন সীমান্তে মাদকের আগ্রাসন ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই মাহেরমজানেও থেমে নেই মাদকের কারবার। মাদকের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বিরোধিতা করলে মিথ্যা মামলা হমলার শিকার হতেহয় তাদের। এ-বিষয়ক জেলা পুলিশ সুপারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভোমরাবাসী।

সমাজের সাধারণ মানুষও জানে তারা চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাদের নাম থাকার পরও তারা বহালতবিয়তে। এসব রাষ্ট্র বিরোধী সমাজ বিধ্বংসী মাদক চোরাকারবারিদের প্রতিহত করতে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এখনি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন জেলার বহু সুধীজন।

সীমান্তে মাদক বৃদ্ধির বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, সীমান্তে ৮ কি.মি ব্যাপী কাজ করে বিজিবি। যেখানে পুলিশ যেতে পারে না। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। মাদক প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।