১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

সান্ধ্য আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা

সান্ধ্য আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা

বাজার করতে গিয়ে দেরী হয়েছে, টিউশন থেকে ফিরতে ৬ টা বেজে গিয়েছে, তাহলে মেইন গেটের সামনে বসে থাকতে হবে; সন্ধ্যার পর হঠাৎ কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হলে, হলের বাইরে যাওয়া যাবেনা। এমন চিত্রই প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেখা যায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) মেইন গেটে এবং ছাত্রী আবাসিক হলে।

সান্ধ্য আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হলের আবাসিক ছাত্রীরা। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাত্রীরা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসলেও এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিকার নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। 

বিতর্কিত এ সান্ধ্য আইন অনুযায়ী, মেয়েদের হলে মাগরিবের আজানের ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আবাসিক শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে প্রশাসন বরাবর। তাদের প্রশ্ন, নিরাপত্তাই যদি এ আইনের প্রধান বিষয় হয় তাহলে সারাদিনে প্রশাসন কি আদৌ একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে। পাশাপাশি হলের গেট বন্ধ করে দিয়ে যে নারী শিক্ষার্থীরা মেইন গেটের সামনে বসে থাকে এতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কতোটুকু নিশ্চিত হয়!

শেখ হাসিনা হলের ছাত্রীরা বলেন, ছেলেদের হলগুলোয় তো এসব হয় না, তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে শুধু এমন নিয়ম কেন পালন করতে হবে? এখানে সান্ধ্য আইন করে লিঙ্গবৈষম্য করা হয়েছে। সান্ধ্য আইনের নামে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর একধরনের বৈষম্যমূলক বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেও কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় একটি মুক্তবুদ্ধি চর্চার জায়গা, এখানে ছেলে-মেয়ে অবাধ বিচরণ করবে এবং ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাবে, এটিই স্বাভাবিক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়া হলের কয়েকজন আবাসিক ছাত্রী জানান, সবার পরিবারের অবস্থা ভালো না বিধায় কারো কারো টিউশনি করাতে হয়, সেক্ষেত্রে ক্লাস শেষ করে টিউশনি করিয়ে এসে সেই মেইন গেইটে বসে থাকতে হয় প্রায় এক ঘন্টার উপরে, কারণ কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের বাস না আসলে আমাদের হলে প্রবেশ করার কোন উপায় নেই। প্রশাসন যে নিরাপত্তার কথা বলে, তাহলে মেইন গেটে রাতে বাধ্য হয়ে বসে থাকাটা কোন নিরাপত্তার মধ্যে পরে!

ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মিম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেখানে রাত ৮টার পরও কোনো ছাত্রী হল থেকে বের হওয়ার স্বাধীনতা পাচ্ছেন, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে মেয়েদের হলে প্রবশে করতে বাধ্য করা হচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজের জন্য হলেও আমরা বের হতে পারিনা। বের হতে গেলেও আগে থেকে প্রভোস্ট স্যারের অনুমতি নিতে হয় তারপরও গেইটে আনসারের কাছে জবাবদিহি করতে হয় যা ভোগান্তি ছাড়া কিছুইনা। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী রোকসানা বলেন, এই সান্ধ্য আইনের কারণেই আমি শেখপাড়াতে একটি মেসে থাকি কারণ টুকটাক প্রয়োজনেও দেখি হলের শিক্ষার্থীরা বাহিরে বের হতে পারে না। কোন জরুরি প্রয়োজনেও তাদের বাইরে আসার সুযোগ নেই বললেই চলে। অনেক দিন ধরেই সান্ধ্য আইন বাতিলসহ বিভিন্ন কথা তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু যে লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে।

সান্ধ্য আইনের কথা তুললে এখানে প্রশাসন মেয়েদের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তুলে ধরে কিন্তু দিনে তারা নিরাপত্তা দিলেও সন্ধ্যার পর কেন পারবে না? ক্যাম্পাস তো নিরাপত্তার জায়গা, নিরাপত্তা আরো জোরদার করে সান্ধ্য আইন বাতিল করা যায় বলে আমি মনে করি। তবে একান্ত বাতিল না করা গেলেও কিছুটা শিথিলতা আনা যেতে পারে। 

শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট ড. এ কে এম শামসুল হক সিদ্দিকী বলেন, হলের গেইট কখন খোলা হবে এবং কখন বন্ধ হবে এটা প্রশাসন থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়, তাছাড়া প্রশাসনের পাশাপাশি প্রোক্টরিয়াল বডিও এসব দেখাশোনা করেন। তবে কোন কারণে যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোন শিক্ষার্থী হলে প্রবেশ করতে ব্যার্থ হন তাহলে যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারলে তার ব্যাপারে বিষয়টি কিছুটা শিথিল করা হয় এবং তাকে হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। 

এ বিষয়ে প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি এ বি এম শেখ জাকির হোসেন বলেন, আমরা যে মাগরিবের আজানের ১৫ মিনিটের মধ্যে হলে ঢোকার ঘোষণা দিয়েছিলাম তা একান্তই শীতকালীন ছুটির জন্য, শীতকাল যেহেতু দ্রুতই অন্ধকার নেমে আসে এবং শীতকালীন ছুটিতে অল্প কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীই হলে অবস্থান করছিলো। তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। তবে এরপর থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি যেহেতু মূল শহর থেকে কিছুটা ভেতরে এজন্য নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনা করেই এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। তারা যেন কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে না পড়ে সে কথা চিন্তা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাদের।

মুত্ত/আরআই