নাটোরের আকাশে শেষ বিকেলে এখন আর আগের মতো দেখা মেলে না পাখিদের দল বেঁধে নীড়ে ফেরার দৃশ্য। ডালে ডালে শোনা যায় না ময়না-টিয়া আর বসন্তের কোকিলের শুললিত কণ্ঠের মধুর কুহু কুহু ডাক, কলকাকলি, পাখিদের সাথে পাখির মিতালী।
খুনসুটিও নেই চড়ুই, বুলবুলি কিংবা বক, মাছরাঙার। শিস দেয়না জাতীয় পাখি ভোরের দোয়েল। আগে প্রচুর দেখা গেলেও বর্তমানে খুবই কম সংখ্যক দেখা মিলে বিশেষ করে ঘুঘু, বাওয়াই, শালিক, টুনটুনি, কাঠ ঠোকরা, কোকিল, ডাহুক, ক্যাসমেচি, বাবুই, বটর, টেইটেরা, গোমড়া ও প্যাচা, সাত ভায়েরা,ভাড়ইসহ অসংখ্য পাখির। বিলুপ্তির পথে চলে গেছে নানা প্রজাতির দেশীয় পাখি। আগের তুলনায় গাছেও নেই তেমন পাখির বাসা।
চলনবিল অধ্যুষিত নাটোরে দিন দিন আশংকাজনক হারে কমছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা। বিভিন্ন দূষণ, বনাঞ্চল ধ্বংস, জলাশয় ভরাট ও শিকারের ফলে পাখি পরিবর্তন করছে তার আবাসস্থল। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য। আতশবাজিসহ বিভিন্ন দূষণ, বনাঞ্চল উজার, শিকারের কারণে দিন দিন কমছে পাখির সংখ্যা। এতে হুমকিতে পড়ছে জীব বৈচিত্র্য।
নাটোরে ভ্রমণে আসা বরিশালের ইমরান হোসেন বলেন,পাখিদের বিলুপ্তর জন্য আমরাই সর্বাত্মকভাবে দায়ী। আমরা দৈনিন্দন জীবনে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম উৎসব পালন করে থাকি। আর উৎসব বলতে আমরা বুঝি আতশবাজি বা পটকা ফাটানো। এগুলোর বিকট শব্দে আমরাই যেখানে কেঁপে উঠি সেখানে এই পাখি গুলো আতশবাজির বিকট শব্দের আতঙ্কে ছুটাছুটি করে। এতে তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। পরিবর্তন করছে আবাসস্থল। এছাড়াও নির্বিচারে গাছপালা ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে কমেছে গাছপালার সংখ্যা । এতে পাখিদের আবাসভূমি তৈরিতে ঘটছে বিঘ্নতা ফলে পাখির সংখ্যা দিন দিন ক্রমাগতই হ্রাস পাচ্ছে। এতে পরিবেশের বিপর্যয়সহ জীব ও বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে।
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী ঘুরতে আসা পারভেজ আকাশ বলেন , পাখির সাথে আমাদের জীব বৈচিত্র্য জড়িত। পাখি বনাঞ্চল গড়ে তুলতে সাহায্যে করে। সেখানে আমরা অবিচারে পাখি শিকার করছি। পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ করে আমরা পাখিদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিচ্ছি। এতে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পাখিদের আবাসভূমি তৈরিতে আমাদের বেশি বেশি গাছপালা লাগিয়ে পাখিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সচেতন হতে হবে।
গুরুদাসপুর বিলচলন শহীদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. আলী আকবর বলেন, পাখিদের বিলুপ্তির জন্য আমরা মানুষ নিজেইরাই দায়ী। কাক হচ্ছে আমাদের প্রাকৃতিক ঝাড়ুদার। মৃত পশু পাখির অংশ খেয়ে পরিবেশ সুন্দর রাখে। আগে সকাল হলে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক দেখা যেত বাড়ির আঙ্গিনায়। কিন্তু এখন দেখা যায় না। এছাড়াও গবাদি পশুদের শরীরে ব্যথা নাশক ইনজেকশন ব্যবহারের কারণে এসব পশুর মৃতদেহ খেয়ে তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যে মারা যায় শকুন। এতেও প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শকুন। নিরাপদ অবস্থানের অভাবে এবং নির্বিঘ্নে পাখি শিকারের ফলে ক্রমান্বয়ে হারি যাচ্ছে আমাদের দেশি প্রজাতির অসংখ্য পাখি। পাখিদের রক্ষার্থে আমাদের সচেতনতা অবলম্বনে কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
নাটোরের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সেই সাথে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যদি বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে পশু পাখির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে না।
নাটোরের বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. মেহেদীজ্জামান বলেন, পাখি নিধন ও শিকারের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে। যারা এসবের সাথে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
তথ্যমতে, দেশে পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৬৫০টি। এর মধ্যে ৩০টি বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে বিলুপ্ত। অবশিষ্ট ৬২০টি প্রজাতির মধ্যে ৪৭৭ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে নিয়মিত দেখা যায়, বাকি ১৪৩ প্রজাতি অনিয়মিত দেখা যায়। নিয়মিত ৪৭৭ প্রজাতির মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশের আবাসিক এবং ১৭৬ প্রজাতি পরিযায়ী পাখি। বিলুপ্ত প্রায় পাখি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সম্মিলিত উদ্যোগ নিবে সরকার, এমনটাই প্রত্যাশা নাটোরবাসীর।
মুক্ত/আরেফিন