হিম শীতল বাতাশ। ভোরের কুয়াশা। প্রকৃতির এমন কতশত বৈরিতা ছাপিয়ে ষাটোর্ধ দিনমজুর আক্কাছ আলীরা এসেছেন পেটের তাগিদে। শরীরটা চাদরে মুড়িয়ে হাতে কাস্তে-কোদাল আর কাঁদে ধান বাহনের বাক নিয়ে অন্যদের মতো নিজেকে তুলেছেন শ্রমিকের হাটে।
শুধু যে আক্কাছ আলীই শ্রমিকের হাটে এসেছেন তা নয়। শ্রম বিক্রির জন্য এই হাটে এসেছেন তার মত শত শত শ্রমজীবি মানুষ। প্রতি ভোড়ে নাটোরের গুরুদাসপুরের নয়াবাজারসহ বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের কাছিকাটা থেকে শুরু করে বড়াইগ্রামের বনপাড়া পর্যন্ত অন্তত ১০টি স্থানে সড়কের দুই ধারে শ্রমিকের এই হাট বসে।
কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রামসহ ৬ উপজেলায় এবছর ১৪ হাজার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে সরিষা ও ১৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সবমিলিয়ে চলতি মওসুমে পেঁয়াজ, ধনিয়া, কালোজিরা আলু, শীতকালিন সবজি, খেসারি, গম-ভূট্টাসহ প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে রবিশষ্য চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। মূলত এসব রবিশষ্য চাষের জন্য এই অঞ্চলে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
কৃষকরা জানান— নাটোর, পাবনা জেলায় কৃষি কাজের জন্য শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করা হয় শ্রমিকের হাট থেকেই। কম মূল্যে পরিশ্রমি শ্রমিক মেলে এই হাটে। শ্রম বিক্রির জন্য হাটে আসা শ্রমিকদের ধান কাটা, রসুন রোপনসহ নানা কাজে ব্যবহার করা যায় বলে তাদের কদরও বেশি।
শ্রম বিক্রির জন্য শ্রমিকের হাটে আসা দিনমজুর আক্কাছ আলী, মাসুম, করিম মোল্লা, আশরাফ খাঁদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার দবিরগঞ্জ এলাকায়। বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটা। ঘন কুয়াশা, হিমেল হওয়ার সাথে প্রকৃতির নানা প্রতিকূলতা ছাপিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা শ্রমিকের হাটে এসেছেন।
আক্কাছ আলী (৬২) বলেন— ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাক, ছোট পিকআপে চড়ে সীমিত ভাড়ায় শ্রমিকের হাটে আসতেন তারা। এখনো সেসব পরিবহনেই আসেন। তবে নানা কারণে পরিবহন ভাড়া বেশি হয়েছে। প্রতিদিন ভোরে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে রাতেই বাড়ি ফিরে যান তারা।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, গত প্রায় একযুগ ধরে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের নয়াবাজারে ‘বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক’ ঘেঁষে শ্রমিকের হাট বসে। জীবিকার তাগিদে আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক হাটে আসেন শ্রম বিক্রি করতে। শ্রমিকের এই কাতারে রয়েছেন নারী-শিশুসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির নারী-পুরুষরাও। এবছর কৃষকের খেয়ে পুরুষ শ্রমিকরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং নারী শ্রমিকরা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা মজুরী পাচ্ছেন।
তাড়াশ থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শত শত ওরাঁও সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষও এখানে এসেছেন। এদের দলনেতা শ্যামলী ওরাঁও ইত্তেফাককে জানান, রসুন রোপন, ধানকাটাসহ সব কাজই তারা করে থাকেন। নিজের খেয়ে জনপ্রতি মজুরি পাচ্ছেন ৪০০ টাকা।
সোমবার ভোড়ে নয়াবাজারের শ্রমিকের হাটে গিয়ে দেখা গেল, স্থানীয় শ্রমিক ছাড়াও তাড়াশ, সলঙ্গা ও উল্লাহপাড়া, বগুড়া, শেরপুর উপজেলা এলাকার শ্রমিকরা দল বেঁধে শ্রমিকের হাটে জমায়েত হয়েছেন। এসব শ্রমিকদের সবাই এসেছেন ট্রাক, নছিমন কিংবা অটোভ্যানে। সকলের গায়েই রয়েছে শীতের পোষাক, হাতে কাস্তে, কোদাল ও ধান বহনের বাক। কৃষক চাহিদামত শ্রমিক দরদাম মিটিয়ে সরাসরি নিয়ে যাচ্ছেন ফসলের মাঠে।
আরিফুর রহমানসহ দশজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিনাহালে রসুন রোপন, ধানের খড় বিছানো, ধানকাটাসহ জমি তৈরির কাজ করানো হয় বহিরাগত এসব শ্রমিক দিয়েই। স্থানীয় শ্রমিকের মজুরী বেশি। অথচ একই কাজ করে বহিরাগত শ্রমিকদের দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। তুলনামূলক কম মজুরিতে কাজ করায় এসব শ্রমিকের চাহিদাও বেশি।
নাটোর কৃষি অফিসের সহকারি পরিচালক ওয়াদুদ বলেন— নভেম্বর মাসটি রবিশষ্য আবাদের ভড়া মওসুম। বহিরাগত শ্রমিকদের কারণে এ অঞ্চলের কৃষক সহজেই চাষাবাদ করতে পারছেন।