১০ অক্টোবর, ২০২৪

পদের দ্বন্দ্বে ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা

পদের দ্বন্দ্বে ভেঙ্গে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা

২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর। এই সময়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতি বদল করা হয়েছে ৮ দফায়। অধ্যক্ষ বদলেছে ৭ বার। সভাপতি এবং অধ্যক্ষ—এই দুইটি পদের দ্বদ্বে ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। গত ৫ বছরে এইচএসসি এবং ডিগ্রী পাসকোর্সের ফলাফলে বিপর্যয় নেমে এসেছে।

গুরুদাসপুর পৌর সদরের নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রোজী মোজাম্মেল মহিলা কলেজে চলছে পদের এমন ভয়াবহ দ্বন্দ্ব। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত সভাপতি বদল করা হয়েছে ১৫ বার এবং অধ্যক্ষ পরিবর্তন করা হয়েছে অন্তত ১২ বার। সবশেষ ১৬ দিনের ব্যবধানে দুই ব্যক্তিকে সরিয়ে নতুন করে সভাপতি ও বিদ্যুৎসাহি সদস্য করা হয়েছে। সভাপতি-অধ্যক্ষ পদের ঘন ঘন অদল বদলের ফলে শিক্ষকরাও দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তার প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। 

কলেজের ফলাফলের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে এইচএসসির ফলাফলে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ ৪ পয়েন্টের নিচে পেয়েছেন। অকৃতকার্য হয়েছেন ৮৪ জন এবং জিপিএ-৫ পেয়েছেন মোটে ১৮ শিক্ষার্থী। এই সময়ের মধ্যে শুধু ২০২১ সালেই সর্বোচ্চ ১৭২ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। ডিগ্রী পাস কোর্সের ফলাফলেও এমন ভঙ্গুর পরিস্থিতি।

যে কারণে এমন বিপর্যয়
২০১৫—২৪ সাল পর্যন্ত পদের দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ১৫ সালে মায়া রানী চক্তবর্তীকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়। দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তাকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয় রুহুল করিম আব্বাসীকে। তার সময়েই শূণ্যপদে অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয় মাহাতাব উদ্দিনকে। কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতা আবু হানিফকে সভাপতি করে মাহাতাব উদ্দিনকে সরিয়ে আবারো অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন রহুল করিম আব্বাসী। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতের দারস্ত হন মাহাতাব উদ্দিন। এরপর সভাপতি করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামকে। এই সময়ে অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রুহুল করিম আব্বাসীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সবশেষ আওয়ামী লীগের পতনের পর অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন উপাধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। এদিকে কলেজ প্রতিষ্ঠাতার ছেলে বিএনপি নেতা আবু হেনা মোস্তফা কামাল রঞ্জুকে এডহক কমিটির সভাপতি করে স্বপদে ফিরে আসেন মাহাতাব উদ্দিন। ১৫ দিনের মাথায় আবারো পরিবর্তন করে ওমর আলী নামের এক ব্যক্তিকে সভাপতি করেন আবুল কালাম আজাদ। 

শিক্ষার্থীরা বলেন, পদের এমন দ্বন্দ্বে শিক্ষকরাও ত্রিমুখী অবস্থান নিয়েছেন। একারণে ঠিকমতো পাঠদান হচ্ছেনা। ফলাফল খারাপ হওয়ায় কমছে শিক্ষার্থী সংখ্যাও।

পদের দ্বন্দ্ব যেখান থেকে শুরু
এই কলেজে পদের দ্বন্দ্বের ইতিহাস দীর্ঘ সময়ের। ১৯৯৪ সালে নিজের জমির ওপর কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন নাটোর-৪ আসনের বিএনপির প্রয়াত সাবেক সংসদ সদস্য এম মোজাম্মেল হক। সেসময় তিনি সভাপতি হয়ে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেন ইব্রাহিম হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে। এরপর তৎকালিন ইউএনও সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস সভাপতি পদে আসেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আবারো সভাপতি হন কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা এম মোজাম্মেল হক। সেসময় নানা অনিয়মের কারণে অধ্যক্ষ ইব্রাহিম হোসেনকে কলেজ থেকে বিতারিত করা হয়। শুরু হয় পদের দ্বন্দ্ব।

সূত্র বলছে, ইব্রাহিম হোসেনের পর সায়মা চৌধুরী নামের এক শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ করা হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করলে একই পদে পৌরনীতির শিক্ষক একরামুল হককে বসানো হয়। তিনিও ২ মাস পর পদত্যাগ করলে আবুল কালাম আজাদ অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন। ২০০৫ সালের তত্ববধায়কের শাসনামলে অধ্যক্ষ হিসেবে আবারো ফিরে আসেন ইব্রাহিম হোসেন। তিনি আব্দুস সাত্তার নামের এক ব্যক্তিকে পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে আব্দুস সাত্তার পদত্যাগ করলে আবুল কাশেমকে সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এই সভাপতি দিয়ে টানা ৯ বছর পার করা হয়েছে। ২০১৫ সালে অবসরে যাওয়ার আগে সাবেক মেয়র শাহনেওয়াজ আলীকে সভাপতি করেন অধ্যক্ষ ইব্রাহিম হোসেন। উদ্দেশ্য ছিল নিয়োগ বাণিজ্য ও অধ্যক্ষ পদে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নেওয়া। নিয়োগ বাণিজ্য করতে পারলেও শিক্ষকদের দাবির মুখে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিতে পারেননি ইব্রাহিম হোসেন।

কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ছাত্রী-শিক্ষকের প্রেমের পর বিয়ে, নিয়োগ বাণিজ্য, আর্থিক অনিয়ম, সভাপতি, অধ্যক্ষ পদ নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে কলেজটি মুখ থুবরে পড়েছে। কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ শিক্ষার্থীদের ফলাফলে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে এসেছে। শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ভাতায় স্বাক্ষর করা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে।

অধ্যক্ষ দাবি করা মাহাতাব উদ্দিন বলেন, তাকে দায়িত্ব থেকে সরাতে নানা ধরণের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বর্তমানে তিনিই অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দাবি করা আবুল কালাম আজাদ বলেন, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় মাহতাব উদ্দিনের নিয়োগ বাতিল করে বিভাগীয় মামলার নির্দেশ দিয়েছে। অথচ ওই ব্যক্তি নিজেকে অধ্যক্ষ দাবি করে মঙ্গলবার কলেজে ঢুকে কাগজপত্র নিয়ে চলে গেছেন। এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে বেতন ভাতায় স্বাক্ষর করে পাঠাচ্ছেন।

কলেজের এ্যাডহক কমিটির সভাপতি ওমর আলী বলেন, রোজী মোজাম্মেল মহিলা কলেজে বর্তমানে কোনো বৈধ অধ্যক্ষ নেই। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপাধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ।