২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

যে গ্রামটি এখনো বিচ্ছিন্ন—অবহেলিত...!

সরস্বতী নদীর ওপারের তীর ঘেঁষে যে গ্রামটি কাল কালান্তরের স্বাক্ষী হয়ে হাজার দুয়েক মানুষকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে— সেই গ্রামটির নাম রশিদপুর নয়াপাড়া। এই গ্রামের মানুষ এখনো উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন—অবহেলিত। সেতু না থাকায় প্রবাহমান সরস্বতী নদীটি নৌকায় পারাপার করে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের।

এই গ্রামটিতে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নেই। আধুনিকায়নের এই যুগে এসে অবহেলিত রশিদপুর নয়াপাড়া গ্রামটি  এখনো বুক পেতে আছে। গ্রামটির অবস্থান উল্লাপাড়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের হাটিকুমরুল ইউনিয়নে। যোগাযোগ বিচ্ছিন এই গ্রাম থেকে উপজেলা সদরের সাথে যোগাযোগের কোনো পাকা সড়কও নেই। বর্ষায় নৌকা আর শুষ্ক মওসুমে বাঁশের সাঁকোই চলাচলের একমাত্র ভরসা।

স্থানীয়রা মুক্ত প্রভাতকে বলেন, পুড়নো এই গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় ভোগান্তি সয়ে দুই কিলোমিটার দুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় এখানকার শিক্ষার্থীদের। সবচেয়ে বেশি বিরম্বনায় পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল্য হওয়ায় চাষাবাদের জন্য সার-বীজ সংগ্রহ বা উৎপন্ন ফসল সময় মতো বাজারজাত করতে না পেরে ন্যাজ্য মূল্য বঞ্চিত হন চাষীরা। অসুস্থ শিশু-বৃদ্ধ এবং গর্ববতী নারীদের নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় নিত্য দিনই। নানামুখী সংকট নিয়ে র্দীঘদিন ধরে বসবাস করছেন এখানকার ২ হাজার বাসিন্দা। 

রশিদপুর নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ আলী, শাহীন রেজা, লিখন আহমেদ ও আব্দুল হাই জানান, উল্লাপাড়া উপজেলার মধ্যে খুবই অবহেলিত গ্রাম তাদের রশিদপুর নয়াপাড়া। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে এই গ্রামে প্রবেশের একটি রাস্তার জন্য তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে অনেকবার আবেদন করেছেন। আবেদন করেছেন পাশের অপ্রশস্ত সরস্বতী নদীর উপর  একটি পাকা সেতুর।

কিন্তু তাদের এই আবেদন কখনই আমলে নেয়নি কেউ। গ্রামে অনেক শিক্ষার্থী। কিন্তু নেই কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়। পার্শ্ববর্তী চড়িয়া শিকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুরত্ব আড়াই কিলোমিটার।

বিশেষ করে শিশু শিক্ষার্থীদের গ্রাম থেকে উক্ত বিদ্যালয়ে যাতায়াতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়। খরা মৌসুমে বাঁশের সাঁকোতে নদীপাড় হবার সময় প্রায়শঃই দুর্ঘটনার শিকার হয় শিক্ষার্থীরা।

বর্ষায় ছোট ডিঙ্গি নৌকায় ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হয় শিশুরা। গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দুরে বগুড়া-নগরবাড়ি সড়কে যেতে হয় গ্রামবাসীর আলপথ পেরিয়ে। বৃষ্টির দিনে যাতয়াতে দুর্ভোগের শেষ থাকে না।

কিন্তু এই দুর্ভোগ নিরসনের কোন উপায় তাদের জানা নেই। এমন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসবাস করতে হচ্ছে পুরো গ্রামবাসীর। ভুক্তভোগীরা অবিলম্বে তাদের গ্রাম থেকে বের হবার একটি রাস্তা, নদীতে পাকা সেতু নির্মান ও গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। 

গ্রামের প্রাথমিক স্তরের শিশু শিক্ষার্থী রনি আহমেদ, তামিম হোসেন, আব্দুল্লাহ ও সুমাইয়া খাতুন জানায়, রাস্তা না থাকায় বর্ষা বৃষ্টির দিনে ফসলের মাঠের আলপথ দিয়ে হেঁটে যেতে অনেকদিন পড়ে গিয়ে কাপড় চোপড় নষ্ট করে বাড়ি ফিরে আসে তারা। আবার নদী পাড় হয়ে সময় মতো স্কুল পৌঁছাতে পারে না। খরা মৌসুমে নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পাড় হতে চরম ঝুঁকিতে পড়তে হয়।

কখনো কখনো বাঁশ ভেঙ্গে নদীতেও পড়ে গিয়ে আহত হয় তারা। ওই সময় নদীতে হাটু পানি থাকায় তারা নদীতে পড়লেও জীবন বাঁচে তাদের। এতো সমস্যা নিয়ে তাদেরকে স্কুলে যেতে হয় প্রতিদিন। 

এব্যাপারে উল্লাপাড়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অফিস প্রধান উপজেলা প্রকৌশলী আবু সায়েদ উল্লিখিত গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের চলাচলের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, অতিসম্প্রতি তার কার্যালয় থেকে ওই গ্রামের সংঙ্গে পাশ্ববর্তী বগুড়া-নগরবাড়ি সড়কের একটি সংযোগ রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ৫০০ মিটার রাস্তা নির্মান করা হবে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট রাস্তা নির্মানের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার কাজ শেষ হলে সরস্বতী নদীর উপর একটি পাকা সেতু নির্মানের বিষয়টি বিবেচনাধীন আছে স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গ্রামবাসীকে সময় দিতে হবে। 

উল্লাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ ছানোয়ার হোসেন জানান, একটি গ্রামে এখন সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে বেশ কিছু জটিল শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রাথমিকভাবে বিদ্যালয়ের জন্য এক বিঘা জমি দান করতে হবে। সেখানে নিজেরা অবকাঠামো তৈরি করবে। তবে স্কুলে সংশ্লিষ্ট গ্রামের কোন ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না।

বাইরে থেকে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। তারপর শিক্ষা অধিদপ্তরে স্কুলটির অনুমোদনের জন্য আবেদন করা যাবে। এতো সব শর্ত পূরণ করতে চায়না গ্রামবাসী। তবে উক্ত গ্রামের লোকজন তার দপ্তরে এসে এখন স্কুল প্রতিষ্ঠায় তাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেছেন। এটা সম্ভব হলে ওই গ্রামে অবশ্যই স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।