বুকের ধন হারিয়ে স্মৃতি হাতড়ে কাঁদছেন মা রজুফা বেগম। বাড়িতে কেউ এলে শুনাচ্ছেন ছেলের দায়িত্বশীলতার কথা। এই তো সেদিনও ছেলে বলেছিল- মা তোমাদের ওপর যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি দেশের ওপরও দায়িত্ব আছে। সেই দেশের জন্যই প্রাণ দিতে হলো রমজানকে (৩০)।
ছাত্র আন্দোলন শেষ হলে বাড়ি ফেরার কথাছিল রমজানের। রমজান ফিরেছিলেন-তবে নিথর দেহ নিয়ে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের আগ মুহূর্তে পুলিশের ছোড়া গুলি এসে লাগে রমজানের বুকের বা পাশে। বুক ছিড়ে পিঠ দিয়ে বের হয় সেই গুলি। সড়কে লুটিয়ে পড়েন রমজান। ছাত্ররা উদ্ধার করে সাভারের এনাম হাসপাতালে নিলে সেখানে দুপুর দেড়টায় মারা যান রমজান।
রমজানের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার সাঐল হাজিপাড়া গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে বসেই ছেলে রমজানের জন্য বিলাপ করছেন বৃদ্ধ পিতা নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, তিন ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে দায়িত্ববান ছিল রমজান। অভাব অনটনের সংসারে মানুষের বাড়িতে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছে সে। করেছে এসএসসি পাস। অল্প বয়সে সৌদি আরব গিয়ে দুই বছর পর দেশে এসে আইএ পাস করে। ডিগ্রিতেও ভর্তি হয়েছিল তার ছেলে রমজান।
তিনি বলেন, সবশেষ ঢাকার বাইপাইলে মাছের আড়তে কাজ করছিল। কিছুদিন পর আবার বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছাত্রদের সাথে আন্দোলন করতে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে গেল তার বুকের ধন।
স্থানীয়রা বলেন, রমজান আলী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পুরোটা সময় সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন বেলা ১১টার পরপরই ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রমজান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে নিহত রমজানের পিতা নজরুল বলেন, মিছিলে যোগদানের কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের ছোড়া একটি গুলি রমজানের বুকের বাঁ পাশে এসে লাগে। পরে সেটি বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মৃত্যু হয় রমজানের। সংসারে অন্য দুই ছেলে থাকলেও বৃদ্ধ পিতামাতা রমজানের ওপরই ভরসা করতেন। এমন অবলম্বন হারিয়ে প্রায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন এই বৃদ্ধ দম্পতি।
রমজানের পিতা বলে উঠলেন, ‘এখন আমার আর ওর মায়ের দায়িত্ব তো কেউ নিচ্ছে না। সংসারে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হইছে। এক ছেলে সৌদি আরবে গিয়ে দালালের পাল্লায় পড়ে আটকা পড়িছে। মেজ ছেলে স্থানীয় বাজারে কাজ করে। আর রমজান সবার ছোট ছিল।’
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সরকার পতনের এক মাস পেরিয়ে গেলেও একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া আর কেউ এই শহীদ পরিবারের খোঁজ নেয়নি। আর্থিক অনটন থাকায় চাঁদা তুলে রমজানের জন্য দোয়ার অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। তবে গত সপ্তাহে ছেলের মৃত্যুসনদ সংগ্রহের জন্য ঢাকায় গিয়ে সরকারের এক উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন রমজানের পিতা নজরুল ইসলাম। তিনি পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
সারাদিন ছেলে রমজানের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান মা রোজুফা বেগমও। বাড়িতে কেউ এলেই ছেলের প্রসঙ্গ তোলেন। আর তাঁর স্মৃতির গল্প বলে বলে আফসোস করেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন।
রজুফা বেগম বলেন, ‘সর্বশেষ গত রোজার ঈদে রমজান বাড়িতে আইছিল। ওরে নিজের হাতে খাওয়াইছিলাম। কোরবানির ঈদে বাড়িতে আসতে পারেনি। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকত। আন্দোলনের মধ্যেও ফোন করিছিল। বলিছিল আন্দোলন শেষ হলেই বাড়ি ফিরব।” ছেলে আমার বাড়ি ফিরিছে লাশ হয়ে।’