২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

একমাসে এক বিদ্যালয়ের ১৯ ছাত্রির বাল্যবিয়ে

একমাসে এক বিদ্যালয়ের ১৯ ছাত্রির বাল্যবিয়ে

সপ্তম থেকে দশম। এই চারটি শ্রেণির ছাত্রী উপস্থিতি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। বিদ্যালয়ে উপস্থিত না হওয়া ছাত্রীদের বেশিরভাগই এখন সংসার ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত। ছাত্র আন্দোলনের একমাসে এক বিদ্যালয়ের অন্তত ১৯ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।

নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর সদরের চাঁচকৈড় শাহীদা কাশেম বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নির্বিচারে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া ১৯ ছাত্রী আর বিদ্যালয়ে আসছে না। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অনুপস্থিত ছাত্রীদের তালিকা করার পর বাল্যবিয়ের বিষয়টি সামনে আসে।

বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে দেশজুড়ে চলা ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে খুব গোপনে সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছাত্রীদের বাল্যবিয়ে দিয়েছে তাদের অভিভাবকরা। দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় বাল্যবিয়ে রোধে শিক্ষকেরাও তেমন কোনো ভূমিকা নিতে পারেননি।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা  বলেন, বেশকিছুদিন বন্ধ থাকার পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাকি হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু বিদ্যালয়ে পাঠদান চালুর পর থেকে সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ১৯জন মেধাবী ছাত্রী বিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত রয়েছে।

এসব ছাত্রীর পরিবারে খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন ১৯জনই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। ছাত্রীদের বাল্যবিয়ের ফলে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শিক্ষকেরাও। বিদ্যালয়ের শিক্ষক জালাল উদ্দিন  বলেন, তার বিদ্যালয়ের যে ১৯ ছাত্রী বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে তাদের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষার্থীও ছিল।

সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে জাল জন্ম সনদ তৈরির মাধ্যমে একশ্রেণীর বিবাহ রেজিস্ট্রার ও নোটারি পাবলিক এসব বিয়ে পড়িয়েছেন। তবে অভিভাবকদের দাবি-রাস্তা-ঘাটে বখাটেদের উৎপাতসহ নানা কারণে অপ্রাপ্ত বয়সেই তারা সন্তানদের বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়ের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম এবং এশিয়ায় প্রথম। বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।

এসএসসি পরিক্ষার্থী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই জরিপ বলছে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সিরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। এরমধ্যে ৬ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে রয়েছে।

গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট গাইনি বিশেষজ্ঞ নারগিস সুলতানা বলেন, বাল্যবিয়ের সবচেয়ে বড় কুফল হচ্ছে কম বয়সে মা হওয়া। বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়ে।

সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে জরায়ু ছিঁড়ে যাওয়াসহ জরায়ুতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। তাছাড়া সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মা এবং শিশু উভয়েই পুষ্টিহীনতায় ভুগে। স্থানীয়রা বলছেন টাকা হলেই কম্পিউটার থেকে সহজেই জাল জন্মসনদ হাতে পাওয়া যায়।

তাছাড়া অর্থলোভি কাজীর যোগসাযোজ, শিক্ষকদের অনিহা, দুর্বল প্রশাসনিক ভূমিকার কারণেই বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়ে উঠছেনা। সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিতু খাতুন জানায়, বিদ্যালয় খোলার পর শ্রেণিকক্ষে সহপাঠি নিপা, সেতু, রোজিনা আক্তার, এলেনা খাতুন অনুপস্থিত রয়েছে।

লেখাপড়ার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও সহপাঠিদের বাল্যবিয়ের ফলে তারও বিদ্যালয়ে আসার আগ্রহ কমেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক নিগার সুলতানা বলেন, বিদ্যালয়ে ১৫০ ছাত্রীর মধ্যে ১৯ জনের বাল্যবিয়ে হয়েছেু। এরমধ্যে ৭ম শ্রেণীর ৪, অষ্টম শ্রেণীর ২, নবম শ্রেণীর ৬, দশম শ্রেণীর ৭ ছাত্রী রয়েছে। বিষয়টি শিক্ষকদের জন্য বেশ উদ্বেগের।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রেখামনি পারভিন বলেন, বাল্যবিয়ের খবর তাদের কেউ জানাননি। একারণে কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা আক্তার বলেন, শাহিদা কাশেম বালিকা বিদ্যালয়ের ১৯ ছাত্রীর বাল্যবিয়ের বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানোর জন্য অভিভাবক সমাবেশসহ নানা পদক্ষেপ নেবেন তিনি।