ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনয়ন। এখানকার অধিকাংশ মানুষের জীবন জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পেয়ারা আবাদ ও কৃষি। ইউনিয়নের এসব খেটে খাওয়া মানুষের সরলতার সুযোগ নিতে শেকড় গেরেছে শিকড় সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি।
এদের উদ্দেশ্য সহজে দ্বিগুন মুনাফার লোভ দেখিয়ে পরিশ্রমের টাকা হাতিয়ে নেয়া। বেশী লাভের আশায় এখানে জমানো টাকা না পেয়ে দিশেহারা সদস্যরা। তারা এখন ঘুরে বেরাচ্ছেন পুলিশ, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে।
উপজেলার ডুমরিয়া গ্রামের এই সমিতির নামে প্রায় ২৫ কোটি টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ উঠেছে। অধিক মুনাফার লোভে কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এখানে তাদের কষ্টার্জিত টাকা জমা রাখেন।
সমিতির গ্রাহকরা থানার সামনে অবস্থান করছেন।
এই অর্থ আত্মসাত করায় সমিতির সদস্যরা সভাপতি সুমন মজুমদার ও সম্পাদক গ্রীন বিশ্বাসকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে সঞ্চয়ের টাকা ফেরতের দাবী জানায়। গত ২৬ জুলাই খবর পেয়ে ঝালকাঠি সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সভাপতি ও সম্পাদককে বিক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে রক্ষা করতে থানায় নিয়ে আসেন।
সমিতির সুত্র জানায়, সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সঞ্চয় আছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। এছারাও মাঠ পর্যায়ে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়া আছে। এছাড়াও সমিতির শেয়ার হোল্ডারদের নামে প্রায় ৭ বিঘা এবং ডুমরিয়া বাজারে ৩ শতাংশ জমির উপর সমিতি কার্যালয়ের দ্বিতল ভবন নির্মান করা হয়েছে। যা সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে সঞ্চয়ের টাকায় ক্রয় করা। ১ লাখ টাকায় ১৫শ টাকা লাভ দেয়ার আশ্বাসে এই টাকা নেয়া হয়।
এলাকাবাসী এবং সমিতির সদস্যদের সাথে কথা বলে জানাযায়, ২০১৩ সালে ২০ জনের সমন্বয়ে শতাধিক সদস্য নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৫ হাজার বলে সমিতির সভাপতি জানান। বর্তমান সভাপতি সুমন মজুমদার তৎকালিন সময়ে ভীমরুলী বাজারে পূরাতন কাপড় সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
এরপর ২০২০ সালে সমিতির সদস্য হন। এক পর্যায়ে ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যানের সমর্থক হিসেবে কাজ করেন। এরপর চেয়ারম্যানের প্রভাব খাটিয়ে সভাপতির পদে অধিষ্টিত হন। তখন থেকেই ঘুরতে থাকে তার ভাগ্যের চাঁকা, তাকাতে হয়নি পেছনের দিকে।
পেয়ে যান ডুমরিয়া ২নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতির পদ। রাতারাতি তিনি সামান্য দর্জী থেকে বনে যান কোটিপতি। হয়ে যান বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। শুধু তাই নয় সমিতি সদস্যদের সঞ্চয়ের টাকায় এবার সে উল্টো ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রহিমকে ৩১ লাখ টাকা দিয়ে সহযোগীতা করেন।
সম্পাদক গ্রীন বিশ্বাস এই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় সভাপতির সাথে মতদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সদস্যদের অভিযোগ তাদের টাকায় কোটি টাকা খরচ করে সভপাতি সুমন গড়ে তুলেছেন বিলাশ বহুল বাড়ীসহ গরুর খামার ও সম্পদ।
সমিতির সদস্যদের সঞ্চয় লোপাটের টাকার সঠিক হিসাব না পাওয়ায় পদত্যাগ করার কথা জানিয়ে কোষাধক্ষ্য শৈলেন হালদার জানান, আমাকে এই পদে কাজ দেয়া হলেও সঠিক ভাবে কোন হিসাব নিকেশ দেয়া হতোনা। তারা সদস্যদের কাছ থেকে আদায়কৃত টাকা কি করতো এবং কোন ব্যাংকে হিসেব খোলা আছে তা আমাকে কিছুই জানায়নি।
জানতে চাইলে বলা হতো আপানার কোন দায় ভার নাই মর্মে লিখিত নেয়ায় এসব আপনার জানার দরকার নেই। এই কারনে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে আমি এখান থেকে পদত্যাগ করে চলে যাই।
গত ২৬ জুলাই সমিতির এজেন্ট পরিচয়ে সভপাতির সামনেই মিনি হালদার জানান, আমার মাধ্যমে ৫ জন ২১ লাখ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে ছিলাম। এখন লাভতো দূরের কথা আসল পেলেই আমরা খুশি। ডুমরিয়া গ্রামের সদস্য কৃষক সুজন বেপারী বলেন, আমার বাবার গাছ ও গরু বিক্রি করে শিকড় সমিতিতে ২ লাখ টাকা রেখে ছিলাম।
দুই বছর আগে রাখা এই টাকার কোন লভ্যাংশ ও আসল টাকার কিছুই দিচ্ছে না সুমন। আমি বলেছি লভ্যাংশের দরকার নেই আসল টাকা ফেরত দেন। তাও পাচ্ছি না। একই গ্রামের যুবক বাদল হালদার জানান, বাবার জমানো এককালিন ৫ লাখ ৩২ হাজার টাকা এখানে রাখা আছে।
মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ার পরেও গত ৬ মাস ধরে চাইলেও কোন টাকাই পাচ্ছি না। সভাপতি বলছে মাঠ থেকে উঠানোর পর টাকা ফেরত দিবে। অথচ আমরা দেখছি সেই টাকা দিয়ে সভাপতি কোটি টাকার বাড়ি, লাখ লাখ টাকার গরুর ফার্ম, বিপুল অর্থ সম্পদ করে স্কুলের সভাপতি পদ পেতে ৭/৮ লাখ টাকা খরচ করছে। আমাদের টাকা গুলো এভাবে খরচ করেছে।
এখন টাকা চাইলে একজন আরেক জনকে দেখিয়ে দিচ্ছে । অমল কৃষ্ণ পেশায় কৃষক। ৫০ হাজার টাকা রেখে ছিলেন ফিক্সড ডিপোজিটে। ৫ মাস আগে মেয়াদ শেষ হলেও এখন টাকা পাচ্ছেন না। এ গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নির্মল বিশ্বাস।
তিনি রেখে ছিলেন অবসরের সাড়ে ৩ লাখ টাকা। ৪ বছর আগে রাখা এ টাকার মেয়াদ শেষ হলেও তা না দিয়ে এভাবে হাজার হাজার মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এই সমিতির সভাপতি। এখন চিকিৎসা খরচ ও সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছিনা বলে আক্ষেপ করেন নির্মল। বেসাইনখান গ্রামের হান্নান মোল্লা।
পেশায় কৃষক এই ব্যক্তি বলেন শিকড় সমিতিতে ৭২ হাজার টাকা রাখছি ৭ বছর আগে। ৭ মাস ধরে টাকা না দিয়ে আমাকে ঘুরাচ্ছে। কৃষক নির্মল সেন বলেন আড়াই লাখ টাকা রাখলেও আসল সুদ কিছুই দিচ্ছেনা। ডুমরিয়ার সুনিল চন্দ্র সরকার ৩ লাখ টাকা এককালিন রেখে কোন টাকা পাচ্ছিনা।
এরকম আমাদের ডুমুরিয়া গ্রামের ১০ কোটি টাকা শিকড় সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। তাই এই সমিতির সদস্যরা অতিষ্ট হয়ে এই টাকা ফেরত পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
টাকা না পেয়ে গত ২৬ জুলাই অতিষ্ট হয়ে সদস্যরা সমিতির কার্যালয়ে এসে সভাপতি সুমন হালদার ও সাধারন সম্পাদক গ্রীন বিশ্বাসকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এই খবর পেয়ে জনরোষ থেকে বাাঁচাতে ঝালকাঠির সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সভাপতি সম্পাদককে থানায় নিয়ে আসে।
এক পর্যায়ে সদস্যরা থানায় এসে ভীর জমায়। এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম জানান, শিকড় সমিতির সভাপতি সম্পাদকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জনরোষ থেকে বাঁচাতে থানায় আনা হয়েছিল। পরবর্তীতে আগামী ২ আগষ্টের মধ্যে সদস্যদের পাওনা টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে তাদের দু’জনকে পাওনাদারদের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।
সুমনের পুরাতন ভিটাবাড়ির পাশে নতুন করে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি।
সভাপতি সুমন মজুমদার সদস্যদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিতে না পারার বিষয়টি স্বিকার করে বলেন, তাদের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে একটি লোনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের পার্শবর্তী পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি উপজেলার নেছারাবাদের দুটি এনজিও কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে পালিয়ে যায়।
এই খবর শোনার পর আমাদের উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলে সদস্যরা। তিনি বলেন, সমিতির রেজিষ্ট্রেশন থাকায় সঞ্চয়ের টাকা ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয়না। সদস্যদের পাওনা টাকা পরিশোধ করা হবে পর্যায় ক্রমে।
তারা একবারে চাওয়ায় সঞ্চয় ও লাভের টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত ২৫ জুন সমিতি কার্যালয়ে এক সভায় আমি উপস্থিত সদস্যদের এ কথা জানিয়েছি। আপনার বিরুদ্ধে সমিতির হিসাবের বাইরে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাত করে ইউপি চেয়ারম্যানকে বড় অংকের টাকা দেয়ার অভিযোগের বিষটি সঠিক নয় বলে জানান সভাপতি। সমিতির সদস্যদের টাকায় রাতারাতি বিপুল অর্থ সম্পদ ও বিলাশবহুল বাড়ির মালিক হওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বিকার করেন।