আমরা তখন জল-জঙ্গল আর নদী ঘেরা এক দ্বীপে। জ্যোৎস্নারাতের জঙ্গলে চলছে ক্যাম্পফায়ার। হৈ-হল্লার মাঝেই সাদামাটা কোনো তথ্য জানান দেয়ার মতো একজন জানালো, কবি আল মাহমুদ আর নেই। জঙ্গলে অনেক পাতার আড়াল ফুড়ে ছুটে আসা একটা তিরের মতোই সেটা গেঁথে গেল বুকে। আক্ষরিক অর্থেই মুচড়ে উঠলো বুক। কতো-না মৃত্যুসংবাদ শুনি, কিন্তু এভাবে, এতোটা মুষড়ে পড়ার অনুভূতি তো হয় না!
ততক্ষণে হৈ-হুল্লোড় থেকে বেরিয়ে গেছি। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি নদীর ধারে, নিরিবিলিতে। অনেকক্ষণ পর পাশে থাকা বন্ধু কথা বলে উঠলো- দেখো, জ্যোৎস্না আর জঙ্গলের আলোছায়ায় গাছগুলো যেন আল মাহমুদের লেখায় উঠে আসা একেকটা চরিত্রের আদল পেয়েছে। সত্যিই তো! ঐ দূরে এক খুকি, ওপাশে ঘোড়ার পিঠে কেউ, খানিক তফাতে মায়ের কোলে শিশু, কাস্তে হাতে কৃষক, সোনালী কাবিনের সেই প্রেমিকযুগল; আর এসবেরই স্বাক্ষী হয়ে ওল্টানো দুধের বাটি থেকে ঝরে পড়া জ্যোৎস্নায় সাপের চলনে দিগন্তে ভেসে যাচ্ছে আরণ্যক নদী। বাংলার এই প্রাণপ্রকৃতিই তো জাগ্রত আল মাহমুদের কবিতায়।
অভিমান আর অনুশোচনায় ভরে উঠলো বুক। আল মাহমুদের প্রশ্নে বাংলা ভাষার পরকাল যে আমাদের ক্ষমা করবে না। দ্বিধান্বিত এ রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা তো তাকে দিতে পারিনি যথাযোগ্য মর্যাদা। তার মূল্যায়নে আমাদের অদূরদর্শীতা সীমাতীত।
শেষ জীবনে আল মাহমুদ আর চোখে দেখতে পেতেন না, অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু আসল অন্ধত্ব তো আমাদের। প্রকৃতপক্ষে আল মাহমুদই সবচেয়ে চক্ষুষ্মান। কেননা পূর্ব-বঙ্গের সাংস্কৃতিক অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের অন্যতম প্রধান নিশানা আল মাহমুদের সাহিত্য। কানা মা’মুদ ঠিকই সব দেখতে পেয়েছেন।
২
চলন্ত ঘরের চলন্ত জানালা বহুক্ষণ বাদে স্থির হলো। কামরার অধিবাসীদের মধ্যে আমরা তিনজন, খোলা জানালার ফ্রেমে আটকে যাওয়া ছবিটার দিকে তাকিয়ে হর্ষোৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। এর নাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া! ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন। তিন কবিতাকর্মী- পলিয়ার ওয়াহিদ, চঞ্চল বাশার আর আমি স্টেশনে নেমে গেলাম।
এই সেই স্টেশন, যেখানে ট্রেন ফেইল করে আল মাহমুদ বাড়ি ফিরে মায়ের শরীরে মুখ ঘষে ঘষে তুলে ফেলেছিলেন প্রত্যাবর্তনের লজ্জা। এখান থেকেই একদিন জাদুকরের মতো ফুলের নকশা তোলা টিনের স্যুটকেসে ভরে যন্ত্র সভ্যতার ঢাকায় তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন নদী, গ্রাম, ফুল আর পাখিদের গান।
মৃত্যুর পর আবারো এখানেই কবির প্রত্যাবর্তন হয়েছে। তবে এই প্রত্যাবর্তনে আর লজ্জা নেই।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে মূলত আল মাহমুদ আর শামসুর রাহমানই বাংলা কবিতার মঞ্জিল কলকাতা থেকে ঢাকার দিকে ফেরান। আজ সেই ঢাকাকে আল মাহমুদ টেনে এনেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আর সেই পথরেখা ধরেই ঢাকা থেকে আমরা এসেছি কবির সমাধি দর্শনে।
আমরা তিনজন; হাতে চারটি ফুলগাছের চারা। বকুল, কৃষ্ণচূড়া, হাস্নাহেনা আর বেলী। ফুলের গন্ধে ঘুম না আসা আল মাহমুদের জন্য এগুলো বয়ে এনেছি আমরা; তার সমাধির চারপাশে লাগাবো বলে।
পলিয়ারের পছন্দ কৃষ্ণচূড়া, চঞ্চল হাস্নাহেনা, আমি বকুল। আর বেলী ফুলের চারাটা হলো নাম না জানা এক মালীর। তার হয়ে আমরাই সেটা বয়ে নিয়ে নিচ্ছি কবির সমাধির দিকে।
আল মাহমুদের মৃত্যুদিনে ঢাকার বাইরে থাকায় তাকে শেষ দেখা বা সমাহিত করার সময় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়নি। সেই দুঃখবোধটা তাড়িয়ে ফিরছিল। সেই থেকেই ভাবছিলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তার সমাধিস্থলে গেলে অন্তত একটা সান্ত্বনা পাওয়া যেতে পারে।
এরই মাঝে আল মাহমুদের মৃত্যুর চার দিন পর ফেইসবুকে কবি সুমন রহমানের পোস্ট করা একটা ছবি দেখে নেচে উঠলো মন। সন্ধ্যার অন্ধকারে আল মাহমুদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সুমন ভাই। তাকে দেখে নিজের যাবার ইচ্ছাটা আরো প্রবল হলো। সেটাতে হেঁচকা টান দিলো পলিয়ার। পথঘাট সব তার চেনা। ফলে আর দেরি না করে কবির মৃত্যুর কয়েকদিন পর, ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে আমরা ট্রেনযোগে রওনা দিলাম তিতাস নদীর তীরে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
৩
এই যে তিনজন, আর বয়ে নিচ্ছি চারটা ফুলের গাছ, এর নেপথ্যে একটা গল্প আছে। রওনা দেয়ার আগের রাতে ঢাকা থেকেই সংগ্রহ করা হয় ফুলগাছগুলো।
আমরা তিনজন, নেবো তিনটা ফুলগাছ। সেই উদ্দেশ্যেই ধানমণ্ডির এক নার্সারি থেকে কেনা হয় এগুলো। মালীকে বলা হয়, খুব ভালো করে গাছগুলো বেঁধে দেয়ার জন্য, এগুলো ঢাকার বাইরে যাবে। কথা প্রসঙ্গে মালী জানতে চান, কোথায়? ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেন? কবি আল মাহমুদের কবরে লাগানো হবে এগুলো।
সেই মালী অনায়াসেই চিনলেন আল মাহমুদকে। হয়তো সুদূর ছেলেবেলায় পড়েছিলেন- ‘আম্মা বলেন, পড় রে সোনা/আব্বা বলেন মন দে, পাঠে আমার মন বসে না/ কাঁঠালচাঁপার গন্ধে…’ বা ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে…’। হয়তো তিনিও সুদূর কৈশোরে কোনো একদিন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া জলা-জংলার আলোছায়ায় গাছের আদলে ফুটে উঠতে দেখেছিলেন বন্য পাখির শিস ধাওয়া করা ঘরপালানো দূরন্ত কোনো বালককে। বললেন, মামা, কবির কবরে আমার তরফে একটা ফুল গাছ লাগায়া দিয়েন। আমি এই বেলী ফুলের গাছটা দিলাম।
সেই বেলী ফুলের গাছটাই বয়ে নিচ্ছি আমরা। উপস্থিত তিনজনে মিলে কোনো এক অনুপস্থিতের গাছ।
৪
কবির কবর খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি আমাদের। শিশুর সরল আহারের মতো সহজ পথ বেয়ে আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম। স্টেশন থেকে নেমেই খানিকটা দূরে। চারপাশে দেয়াল তোলা মফস্বলের এক শান্ত গোরস্থান। ভেতরটা পরিচ্ছন্ন, গাছপালাও যথেষ্ঠ, নিরিবিলি। এ মাথা থেকে ও মাথা সারি সারি কবর।
এক শিশুই আমাদের চিনিয়ে দিলো আল মাহমুদের কবরটা। মোল্লাবাড়ির অংশে মা-বাবার পাশে তার ন্যাড়া কবর। একদম সাধারণ একটা কবরে শুয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম কবি। সেখানে নেই এমনকি কোনো নামফলক।
অনেকক্ষণ নীরব হয়ে যার যার মতো সেই সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। এরই মাঝে শিশুদের দলে ভিড়িয়ে শাবল আর পানিভর্তি বালতির জোগাড়যন্ত্র করে ফেলেছে পলিয়ার। নিজেদের হাতে কবির শিথানে, পৈথানে, পুবে আর পশ্চিমে সেই চারটি ফুলগাছ লাগিয়ে আমরা বিদায় নিলাম। হায়, যদি কোনো দিন এর একটা গাছেও আসে ফুল, আর আমাদের অস্ফুট প্রেম হয়ে ঝরে পড়ে কবরের ওপর।
কবরস্থান থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম আল মাহমুদের আজন্ম লালিত নদী তিতাসের তীরে। সেখানে উন্মোচিত হলো অভাবিত এক দৃশ্যপট। নদীর ধারে শুরুতেই কাল-ভৈরবের মন্দির, পাশে শ্মশানঘাট, এরপরেই বেওয়ারিশ লাশের এক গোরস্থান, তারপর নাথ ধর্মাবলম্বীদের শ্মশান, আর তারই কোল ঘেঁষে এক মাজার আর তার পাশে এক হাফেজিয়া মাদ্রাসা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা সাংস্কৃতিক বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এরা। কেউ কাউকে কিচ্ছু বলছে না। কারো আপত্তি নেই এই যূথবদ্ধতায়। আল মাহমুদ-তো এই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আর এই তিতাসেরই সন্তান। তিনি-তো এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই সন্ধান করেছেন নিজের লেখায়।
যুগে যুগে সনাতন, হিন্দু, বৌদ্ধ, আর শেষে ইসলামি সংস্কৃতি সিঞ্চিত পূর্ববঙ্গের মানুষের লৌকিকতা, ধর্মাচার, আধ্যাত্মবোধের স্বরূপ কী তারই উৎকৃষ্ট নিশানা আল মাহমুদের সাহিত্য।
ফলে আল মাহমুদের যে বাংলা, তার ইতিহাস কেবল পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসমাত্র নয়। হাজার হাজার বছরের পূর্ব-বাংলার ইতিহাস। তাই আল মাহমুদকে বুঝে উঠতে হলে শুরু করতে হবে সেই সুদূর ইতিহাস থেকে। আমলে নিতে হবে সেই ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এই জনপদের মানুষের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যত ঝড়-ঝঞ্ঝা, লড়াই আর সংগ্রামকে।
সেই ইতিহাসের পালাবদলে এই মাটির সন্তানকে অসুর, নমঃশূদ্র, বৌদ্ধ, মুসলমান হতে হয়। শাহী বাংলার প্রান্তর থেকে যাত্রা করে বারো ভূঁইয়া হতে হয়। সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ করতে হয়, দেশভাগ আর বায়ান্ন হয়, হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। শাহবাগ আর হেফাজতের লড়াই ও বিভেদ সেই দীর্ঘ ইতিহাসেরই দ্বিধান্বিত দুই মেরু আর মধ্যবর্তী ধূসরতার মতো। তবু এই ভেদাভেদের মাঝখানে কোথাও এক মিলনবিন্দু আছে, সেই মিলনবিন্দুরই অন্যতম নিশানা আল মাহমুদ। সেখানেই ধান, দূর্বা, বধুবরণ, গাঙ আর কবুল কবুল সব এক হয়ে যায়।
আল মাহমুদ পূর্ববঙ্গের সেই জীবনাচারের লোক, যেখানে বধুবরণের নামে কুলায় ধান-দূর্বা হাতে দাঁড়ায় মহামাতৃকুল আর গাঙের ঢেউয়ের মতো বলে কন্যা, কবুল কবুল। এই লৌকিক ধর্মের স্বরুপই তিনি তুলে ধরেছেন নিজের লেখাজোখায়।
মানুষ পেছনের দিকে তার ইতিহাসের সমান, আর সামনের দিকে তার আশার সমান বড়। আজকের বাংলাদেশকে সেই বিশাল ইতিহাসের পাটাতনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চিনে নিতে হবে। নিজেকে চিনে নেয়া সত্যিই বড় কঠিন!
৫
মিশেল ফুকো তার ‘দ্য অর্ডার অব থিংস’ বইটিতে স্পেনদেশীয় চিত্রকর দিয়েগো ভেলাসকেজের রহস্যঘন চিত্রকর্ম ‘লাজ মেনিনাস’ (১৬৫৬) বা ‘সহচরীর দল’-এর উদাহরণ টেনে ডিসকোর্স ও বিষয়ী প্রসঙ্গে বিস্তর আলোচনা করেন। নিজেকে বা বিষয়ীকে খুঁজে পাওয়া যে সহজ কর্ম নয়, ‘লাজ মেনিনাস’ ব্যবহার করে তা বোঝাবার চেষ্টা করেন ফুকো।
বারোক শিল্পরীতির বহুল আলোচিত এই ছবিটিতে আমরা দেখি আলোছায়াময় এক ঘরে হাতে রং-তুলি নিয়ে দর্শকের দিকে পিঠ ফেরানো একটি ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছেন এক চিত্রকর। ক্যানভাসে কী আঁকা হচ্ছে তা দর্শকদের চোখের আড়ালে। তারা কেবল দেখছেন, নিজেদের ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে দাঁড়ানো চিত্রকরকে। তার পাশেই ছবিটির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে ছোটো এক রাজকুমারী, রাজকুমারীকে ঘিরে দাঁড়ানো পরিচারিকার দল, পাশেই বামন-নারী, কুকুরসহ আরো বেশ কয়েকটি চরিত্র। সবার পেছনে, দূরে দরজার চৌকাঠ ধরে এই জমায়েতের দিকে তাকিয়ে আছেন এক ব্যক্তি।
ছবিটির দিকে তাকালে প্রথম ধাক্কাতেই দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছোট্ট ঐ রাজকুমারী। মনে হয়, সেই-ই ছবির মূল চরিত্র। কিন্তু না, একেবারেই তা নয়।
ছবিটির সবচেয়ে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো, রাজকুমারীর ঠিক পেছনে ঘরের যে দেয়াল, সেই দেয়ালে টানানো আছে এক আয়না, আর সেই আয়নায় দেখা যাচ্ছে স্পেইনের রাজা চতুর্থ ফিলিপ ও তার স্ত্রী রানি মারিয়ানার প্রতিবিম্ব। ছবিটির মূল চরিত্র বা বিষয় আসলে তারাই।
মূলত ফিলিপ ও মারিয়ানাই বসে আছেন দর্শকের দিকে পিঠ ফিরিয়ে থাকা ক্যানভাসটির পেছনে। সে কারণেই পুরো ছবিতে তাদের উপস্থিতি নেই; কিন্তু পেছনে, দেয়ালের ঐ আয়নায় ভেসে ওঠা প্রতিবিম্ব নির্দেশ করছে তাদের অবস্থান।
অর্থগত মাত্রা বাড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবেই ছবিতে ফিলিপ ও মারিয়ানার বসে থাকা অংশটি আড়ালে রেখেছেন ভেলাসকেজ। কিন্তু এবারে ভালো করে তাকালে বোঝা যাবে, রাজা-রানীরই ছবি আঁকা হচ্ছে ঐ ক্যানভাসে, আর রাজকুমারী থেকে শুরু করে সবাই আসলে তাকিয়ে আছে তাদেরই দিকে। এভাবেই অনুপস্থিত থেকেও উপস্থিতে পরিণত হয়েছেন তারা।
‘লাজ মেনিনাস’-এ এভাবেই যা অনুপস্থিত, তা পরিণত হয় বিষয়ে। অনুপস্থিতই এখানে সবচেয়ে বেশি উপস্থিত। আয়নামহলে ভেসে ওঠা রাজারানীর ঐ প্রতিবিম্ব তারই এক অনন্য নজির। কিন্তু এক নজরেই তা সবার চোখে ধরা পড়ে না।
লাজ মেনিনাস ছবির মজাটা হলো, ছবিতে অনুপস্থিত রাজা-রানী আসলে সেই জায়গাটিতে আছেন, ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে দর্শক ছবিটি দেখছে। ফলে রাজা-রানী নয়, আয়নায় ভেসে ওঠা প্রতিবিম্বটি শেষাবধি খোদ দর্শকেরই। কিন্তু হায়, দর্শক নিজের চেহারাটি চিনতে পারছে না। বুঝতেই পারছে না যে, সেই ঐ ছবির বিষয়।
আল মাহমুদ সেই কবি, যিনি এভাবেই আয়নায় পূর্ববঙ্গের মানুষের অবয়ব এঁকেছেন। কিন্তু আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা, নিজেদের শরীর হারিয়ে ফেলা আমরা সেই অবয়বটাকে চিনে উঠতে পারছি না।
আদতে আল মাহমুদের কবরে মালীর দেয়া ঐ চতুর্থ গাছটি, সেই বেলী ফুলের গাছটি হলো আরেক ‘লাজ মেনিনাস’। নাম না জানা মালীর ওই ফুলগাছ আসলে আপাত অনুপস্থিত জনমানুষের প্রতিনিধি; যারা কবিকে আপনার লোক বলে জানে, যারা লৌকিক বাংলার মানুষ। ওই ফুলগাছ এক আয়না, যার মধ্যে সেই জনপদের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। শুধু গভীরভাবে তাকালেই টের পাওয়া যাবে, কবির কবরে অর্ঘ্য হয়ে যাওয়া ওই ফুলগাছটি আদতে কোনো নামের দেয়া নয়; বরং সর্বনামের।