১৪ জানুয়ারি, ২০২৪

শুষ্কের শুরুতেই শুকিয়ে খাক খরস্রেতা বড়াল

বছর বিশেক আগেও বড়াল ছিল খরস্রোতা নদী। এক বড়ালের যৌবনে টৈটম্বুর ছিল চলনবিলের মতো বৃহৎ একটি বিল। বড়ালের পানিতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতো নন্দকুঁজা, নারদ, চিকনাই, রূপনাই, আত্রাইয়ের মতো বড় বড় নদীও। শুষ্ক মওসুমের শুরুতে সেই বড়াল নদীই এখন শুকিয়ে খাক।  

পদ্মায় জন্ম নিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা বড়াল নিজেকে বিলিন করেছে যমুনার পেটে। ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীর পেট জন্ম দিয়েছে নদী, নালা, খাল-বিল। পদ্মা—যমুনার পানি এই নদী হয়েই গড়িয়ে পড়তো ছোট বড় নদী আর খাল বিলে। বড়ালের ভরা যৌবন শুরু হয়েছিল ৫’শ ফিট প্রস্থের প্রসার দিয়ে। 

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে— উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৮৪ সালে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় ৫’শ ফিট প্রস্থের বড়ালের উৎস্যমুখে মাটির বাঁধ দিয়ে বন্ধ করা হয় নদীটির প্রবাহ। সেসময় ওই বাঁধের কারণে উত্তাল পদ্মার পানি আর বড়ালে গড়ায়নি। এতে করে খরায় পরে ভাটি অঞ্চলের চলনবিলছাড়াও ৪ জেলা ও ৮ উপজেলার নদী-নালা। ভাটি এলাকার মানুষের দাবির মুখে ৫’শ ফিট প্রস্থের ২১ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের বড়ালের উৎস্যমুখে ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের ৩০ ফিট প্রস্থের জলকপাট নির্মাণ করা হয়। সেই জলকপাটই গিলে খেয়েছে বড়ালের যৌবন।

এরপর থেকে নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের ফলে পানি প্রবাহ কমে আসায় তৃষ্ণায় পড়েছে চলনবিল ও এর বুকচিরে বয়ে যাওয়া আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধরসহ অসংখ্য নদী-নাল খালসহ ৪০টির মতো নদী, শ’দুয়েক নালা এবং ছোট বড় অন্তত ২৫০টি বিল। ১৯৮৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে মানচিত্র থেকে মুছে গেছে মির্জামামুদ, তুলশীগঙ্গার মতো বেশকিছু নদীর চিহৃ।

বাগাতিপাড়ার কৃষক জাহেদ মোল্লা বলেন, অসময়ে বড়াল শুকিয়ে যাওয়ায় নদীর পেটে চাষাবাদ করছেন তারা।

বড়ালপাড়ের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা বড়াল নদীটি নাটোর, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর, সিরাজঞ্জের তাড়াশ, বাগাতিপাড়া, লালপুর এলাকার মুশাখাঁ, আত্রাই, গুমানি, নন্দকুঁজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর নদী হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। 

বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, ৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিত ভাবে নদীর উৎস্য মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিতে স্লুইসগেট নির্মাণ করার পর থেকেই মরতে বসে বড়ালের পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটানো চলনবিল ও এর পেটে বয়ে চলা নদী-নালা। আন্দোলন করেও স্লুইসগেটটি অপসারণ করা যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ২০০৮ সাল থেকে বড়াল ও চলনবিলের নদ-নদী রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আই ডব্লিউ এম) বড়াল নদীর পানি সম্পদ পুনরুদ্ধারে সমীক্ষা প্রকল্প শুরু হয়। ওই সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বড়ালের উৎস্যমুখে চারঘাট এলাকায় দেওয়া সরু স্লুইসগেট অপসারণ করে সেখানে ব্রিজ নির্মাণ এবং বেহাত হওয়া ১২০ কিলোমিটার দখলমুক্ত করাসহ ২২০ কিলোমিটার নদী খননের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড চারঘাটের স্লুইসগেট বহাল রেখে প্রকল্পটিকে দুইভাবে বিভক্ত করে বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এতে শুধু দীর্ঘ সূত্রিতাই বাড়বে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বড়ালের উৎস্যমুখে নির্মীত স্লুইসগেটটি বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না। বছরখানেক আগে ‘বড়াল নদীর অববাহিকায় পানি সম্পদ পুনরুদ্ধার’ নামে একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে।