পদ্মায় জন্ম যমুনায় বিলিন। নদীটির নাম প্রমত্তা বড়াল। ২২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীর পেট চিরে জন্মেছে নদী, নালা, খাল-বিল। পদ্মা—যমুনার পানি এই নদী হয়েই গড়িয়ে পড়তো দেশের সর্ববৃহত চলনবিলে। অথচ ৫’শ ফিট প্রস্থের নদীটির উৎস্যমুখে ১৯৮৪ সালে নির্মীত হয়েছে তিন কপাটের একটি সরু স্লুইসগেট।
সেই থেকে বড়াল তার যৌবন হারিয়েছে। যৌবন হারিয়েছে গুরুদাসপুরের নন্দকুঁজা, নারদ, চিকনাই, রূপনাইয়ের মতো চারটি বড় নদীও। একইসাথে চলনবিল ও এর বুকচিরে বয়ে যাওয়া ৪০টির মতো নদী, শ’দুয়েক নালা এবং অন্তত ২৫০টি বিল মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। ১৯৮৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে মিলিয়ে গেছে মির্জামামুদ, তুলশীগঙ্গার মতো বেশকিছু নদীর চিহৃ।
বড়ালপাড়ের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাজশাহীর চারঘাট থেকে উৎপত্তি হয়ে চলনবিলের বুক চিরে বয়ে চলা বড়াল নদীটি নাটোর, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, চাটমোহর, তাড়াশ, বাগাতিপাড়া, লালপুর এলাকার মুশাখাঁ, আত্রাই, গুমানি, নন্দকুঁজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা-যমুনা নদী এবং বিশাল জলাভূমির চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী বড়াল। এই নদী ৪টি জেলা ও ৮টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিত ভাবে নদীর উৎস্য মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিতে স্লুইসগেট নির্মাণ করার পর থেকেই মরতে বসে বড়ালের পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটানো চলনবিল ও এর পেটে বয়ে চলা নদী-নালা।
খোঁজনিয়ে জানাগেছে— উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৮৪ সালে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় ৫’শ ফিট প্রস্থের বড়ালের উৎস্যমুখে মাটির বাঁধ দিয়ে বন্ধ করা হয় নদীটির প্রবাহ। সেসময় ওই বাঁধের কারণে উত্তাল পদ্মার পানি আর বড়ালে গড়ায়নি।
এতে করে খরায় পরে ভাটি অঞ্চলের চলনবিলছাড়াও ৪ জেলা ও ৮ উপজেলার নদী-নালা। ভাটি এলাকার মানুষের দাবির মুখে ৫’শ ফিট প্রস্থের ২১ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের বড়ালের উৎস্যমুখে ৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহের ৩০ ফিট প্রস্থের জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের ফলে খরস্রোতা বড়াল তার জৌলুশ হারায়। ২২০ কিলোমিটার নদীর মধ্যে ৩৮ বছরে বড়ালের ১২০ কিলোমিটার বেদখল হয়েছে।
শুধু বড়ালের পানি প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চলনবিলের নদী ও খালের মধ্যে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধরসহ অসংখ্য নদী-নাল খাল তিন দশকের বেশি সময় ধরে খরায় পুড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ২০০৮ সাল থেকে বড়াল ও চলনবিলের নদ-নদী রক্ষায় আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আই ডব্লিউ এম) বড়াল নদীর পানি সম্পদ পুনরুদ্ধারে সমীক্ষা প্রকল্প শুরু হয়।
ওই সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বড়ালের উৎস্যমুখে চারঘাট এলাকায় দেওয়া সরু স্লুইসগেট অপসারণ করে সেখানে ব্রিজ নির্মাণ এবং বেহাত হওয়া ১২০ কিলোমিটার দখলমুক্ত করাসহ ২২০ কিলোমিটার নদী খননের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড চারঘাটের স্লুইসগেট বহাল রেখে প্রকল্পটিকে দুইভাবে বিভক্ত করে বাস্তবায়ন করতে চাইছে। এতে শুধু দীর্ঘ সূত্রিতাই বাড়বে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে— বছরখানেক আগে ‘বড়াল নদীর অববাহিকায় পানি সম্পদ পুনরুদ্ধার’ নামে একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়ে ২ হাজার ৫২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় বড়াল নদীর ১০৪ কিলোমিটার, নারোদ নদীর ৪৩ কিলোমিটার এবং মুসাখাঁ নদীর ৬ কিলোমিটার খননের কথা বলা হয়েছে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বড়ালের উৎস্যমুখে নির্মীত স্লুইসগেটটি বর্তমানে কোনো কাজে আসছে না। তবে এটি তৎকালীন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণের কারণে।
ইম্পেরিয়েল গেজেট অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চলে ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান নদী ৯টি, ২০টি খালসহ ছোট ছোট বিভিন্ন বিল ও খাল রয়েছে। অতীতে ২৩ হাজারের মত বড় বড় পানির আধার ছিল। যা বেশীর ভাগই বেদখলকৃত ও হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড.মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌচলাচল করতো। কিন্তু পানির প্রবাহ না থাকায় বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানমতে, প্রতি বছর ২২২১/২ মিলিয়ন ঘণফুট পলি প্রবেশ করে।