১৪ জুলাই, ২০২৩

৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ

  থানা হেফাজতে আসামিদের পুলিশী নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে আদালতে। এঘটনায় অভিযুক্ত একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের জন্য নাটোরের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন লালপুর আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মো. মোসলেম উদ্দীন। 

অভিযুক্ত বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজিব, লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. উজ্জ্বল হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদ হাসান, ওমর ফারুক ও এক কনস্টেবলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্দেশ দেন আদালত। একইসাথে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদনও জমা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।

মূলত নাটোরের লালপুরে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া চার আসামির মধ্যে তিনকেই নির্যাতন করার বিষয়ে আদালতে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে— লালপুরের অটোরিকশা ছিনতাই মামলায় আসামি মো. সালামকে রোববার (৯জুলাই) দিবাগত রাত ১টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে, শামীম মোল্লাকে সোমবার (১০ জুলাই) দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ি থেকে এবং সোহাগ হোসেনকে রোববার (৯জুলাই) দিবাগত রাত পৌনে ৯টার দিকে উত্তর লালপুর গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে লালপুর-থানা পুলিশ। 

স্থানীয় সূত্রে জানাগেছে, মো. সোহাগ হোসেন (৩০) পাবনার ঈশ্বরদীর ফতেহ মোহাম্মদপুর গ্রামের, মো. সালাম (৩১) মোকাররমপুর গ্রামের বাসিন্দা। অপর দুই আসামির মধ্যে মো. শামীম মোল্লা (২৯) নাটোরের বড়ইগ্রামের নগর গ্রামের ও মো. রাকিবুল ইসলাম (৩০) কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বারাদি গ্রামের বাসিন্দা। আসামিরা আদালতের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে থানা হেফাজতে শারিরীক ও মানশিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন।

আদালতের বেঞ্চ সহকারী আব্দুল্লাহ বিশ্বাস বলেন, বুধবার আসামিদের লালপুর আমলি আদালতে হাজির করা হয়। আসামিদের মধ্যে সোহাগ হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবাবনবন্দি রেকর্ড করার জন্য আদালতের কাছে আবেদন করেন মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ওমর ফারুক। এসময় তদন্তকারী কর্মকর্তা অন্য আসামিদের জেলহাজতে পাঠানোর জন্য আবেদন করেন। এসময় চার আসামির মধ্যে তিনজনই আদালতের কাছে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।

তবে অভিযোগের ব্যবপারে লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) উজ্জল হোসেন আজ শুক্রবার সকালে জানান, থানা হেফাজতে আসামি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। 

অটোরিকশা ছিনতাই মামলার আসামি সোহাগ হোসেন আদালতে দেওয়া তার জবানন্দিতে উল্লেখ করেন, ৯ জুলাই (রোববার) রাত পৌনে ৯টার দিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে ওসি উজ্জ্বল হোসেন তাঁকে চোখ বেঁধে মারধর শুরু করেন। তারপর ১১ জুলাই থানা-হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে ওসি তাঁর পায়ের তালুতে লাঠি দিয়ে মারেন এবং অণ্ডকোষে লাথি দেন। এরপর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরিফ আল রাজিব তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকার করতে বলেন। না হলে ওখান থেকে তাঁকে রিমান্ডে নেবেন। তারপর এমন মামলা দেবেন যাতে আর কোনো দিন বউ-বাচ্চার মুখ দেখতে না পারেন।

অপর আসামি মো. সালাম তাঁর জবানবন্দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করেন, ৯ জুলাই রাতে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে আসে। সেদিন তাঁকে মারধর না করলেও পরদিন (১০ জুলাই) ওসি থানায় এসেই থাপ্পড় মারতে থাকেন। তারপর থানার ওপর তলায় নিয়ে এসআই জাহিদ হাসান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই ওমর ফারুক তাঁর কনিষ্ঠ আঙুলের ওপরে টেবিলের পায়া রেখে চাপ দিতে থাকেন। এতে সেলিমের কনিষ্ঠ আঙুলের ওপরে, মধ্যমা আঙুল ও অনামিকা আঙুল মারাত্মকভাবে ক্ষত হয়। তারপর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে টাখনুর ওপর পর্যন্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এরপর ১২ জুলাই আবার তাঁকে পেটানো হয়।

আসামি শামীম মোল্লাও আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দিতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁকে ১০ জুলাই রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তারপর রাস্তায় মারতে মারতে থানায় নিয়ে আসে। ১১ জুলাই সকালে থানার ওপর তলায় নিয়ে একজন কনস্টেবল, এসআই জাহিদ হাসান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ওমর ফারুক চোখ বেঁধে টেবিলের নিচে মাথা রেখে মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড মারপিট করেন। তারপর দুই পা বেঁধে পায়ের তালুতে পেটান ও বুকে বারবার লাথি দিতে থাকেন।

এদিকে আদালত আসামিদের জবানবন্দি গ্রহণের পর নাটোরের জেল সুপার ও আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে আসামিদের বক্তব্য ও শরীরের আঘাতের চিহ্ন পর্যালোচনা করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নির্দেশ দেন। বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) বিকেল চারটার মধ্যে আসামিদের শরীরে থাকা জখমের কারণ এবং জখমের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রস্তুত করে আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতের কাছে আসামিদের শরীরে থাকা জখমের কারণ এবং জখমের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন নাটোর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. সামিউল ইসলাম।

আদালত সূত্রে জানাগেছে, চিকিৎসকের দেওয়া প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অভিযোগকারী তিন আসামির মধ্যে মো. সালাম এবং মো. শামীম মোল্লার শরীরে নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পান আদালত। অপর আসামি সোহাগের শরীরে দৃশ্যমান আঘাতের চিহ্ন নেই বলে চিকিৎসক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

এ বিষয়ে নাটোরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান বলেন, আদালতের আদেশের কথা তিনি শুনেছেন। আদেশের কপি পেলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন তিনি।