-ছবি লেখকের
ডাক্তারের সফল অপারেশনে মানুষ যেমন নবজীবন ফিরে পায় । ঠিক ওই ডাক্তারেরই একটি ভুল অপারেশনের কারনে জীবিত মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় । তেমনি গণমাধ্যমের একজন রিপোর্টারের প্রতিটি রিপোর্ট একেকটি অপারেশনের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ।
একটি রিপোর্ট শুধু একজন মানুষকে নয়, একটি জনগোষ্ঠী, একটি সংগঠন ও একটি জাতিকে নবজীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে । আবার ওই রিপোর্টারের একটি ভুল রিপোর্টে একজন মানুষ, একটি জনগোষ্ঠী, একটি সংগঠন ও একটি জাতিকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে ।
এমন কী কোন কোন ক্ষেত্রে একজন রিপোর্টারের একটি মাত্র রিপোর্ট গোটা বিশ্বে তোলপাড় ঘটিয়ে দিতে পারে । উইকিলিকস ও পানামা পের্পাসে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো আমাদের সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । একটিমাত্র রিপোর্টের কারনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে পদত্যাগ করতে হয়েছে ।
অনেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের যেতে হয়েছে জেলে। সুতরাং একজন রিপোর্টারের একটি রিপোর্টের গুরুত্ব এতটাই অপরিসীম যা ভাষায় বনর্না করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । একটি ভুল রিপোর্টের কারণে খ্যাতিমান ব্যক্তির মান সম্মান ধূলোয় মিশে যেতে পারে, ধ্বংস হয়ে যেতে একটি জনগোষ্ঠী, বিলীন হয়ে যেতে একটি সংগঠন ও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে একটি জাতি ।
আবার ভুল রিপোর্টের কারণে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের জীবনও বিপন্ন হতে পারে । সুতরাং রিপোর্টের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা, তথ্যের সত্যতা যাচাই ও সাবধানতা অবলম্বন করা অপরিহার্য । একজন রিপোর্টার তার রিপোর্টের মাধ্যমে সকলকেই দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে ।
এমন কী ওই নির্দেশনার আলোকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে । আর অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টের ক্ষেত্রে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট বিচারকের একটি রায়ের কাছাকাছি । কেননা ওই রিপোর্টই বলে দিচ্ছে কি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে আর এ অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তি কে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যও থাকে সেখানে । সুতরাং একজন রিপোর্টারের ভুল ধরিয়ে দেয়ার জন্য বা ভুল সংশোধনের জন্য আদালতের কাঠগড়ার প্রয়োজন নেই ।
আইন কানুনের ফ্রেমে আটকিয়ে শাস্তির ভয় দেখানোর প্রয়োজন নেই । একজন রিপোর্টারের বিবেকই তার জন্য কাঠগড়া । ভুল সংশোধন করার জন্য একজন রিপোর্টারের বিবেকই তার জন্য যথেষ্ট । একটি ভুল রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ওই রিপোর্টারের বিবেক তাকে দংশন করবেই ।
প্রতিদিন রিপোর্টারকে পরীক্ষা দিতে হয়, প্রতিদিন পাঠকের সামনে হাজির হতে হয় । একটি ভুল রিপোর্টের কারনে শুধু রিপোর্টারই দায়ী হয় না, বরং সে দায় সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সম্পাদক, প্রকাশক ও মালিকের উপর গিয়েও বর্তায় । এমন কী রিপোর্টারের ভুলের কারণে সম্পাদককেও জেল খাটতে হয় ।
প্রত্যেক রিপোর্টারই একজন মানুষ । আর একজন মানুষ হিসেবে ভুল ভ্রান্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকদেরকে জাতির বিবেক বলা হয় । আমরা জাতিকে বিবেকের মতো দিক নির্দেশনা দিয়ে তাকে একজন রিপোর্টারের একেকটি রিপোর্ট । এই কারণে রিপোর্টারদের আরো শাণিত ও নিরপেক্ষ হতে হবে ।
যাতে করে রিপোর্টে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা প্রকাশ পায় । অবশ্য আমাদের গণমাধ্যমগুলোর পলিসির কারণে সকল রিপোর্টে তা প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তবু বেশকিছু নীতিমালা আমাদের মেনে চলা উচিত ।
তা না হলে যে কোন সময় আমরা নিজেরাই বিপদের সম্মুখীন হতে পারি । আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে অনেকসহকর্মী রয়েছেন, যারা রিপোর্টের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন । হয় চাকুরি হারাচ্ছেন নতুবা মামলা- হামলার শিকার হচ্ছেন ।
বিধিমালা অনুযায়ী সাংবাদিককের জন্য একটি শপথনামাও রয়েছে। এই শপথনামায় ৯টি বিষয়ে শপথ পাঠ করতে হয় । তা হলো- ১) আমি দ্বিধাহীন সততার সঙ্গে সংবাদ এর প্রতিবেদন, ভাষ্য ও বিশ্লেষন প্রণয়ন করবো ২) আমি স্বেচ্ছায় কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করবো না এবং সত্যকে বিকৃত করবো না ৩) আমি সর্বাবস্থায় সংবাদ উৎসের গোপনীয়তা রক্ষা করবো ৪) আমি সর্বাবস্থায় নিজের পেশাগত সহমর্মিতা ও সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষা করবো ৫) আমি কখনও কারও কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করবো না অথবা বিচার বিবেচনাকে প্রভাবিত করতে পারে এরূপ ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রশ্রয় দেব না ৬) আমি সংবাদ, সংবাদচিত্র এবং দলিলাদি সংগ্রহে সর্বক্ষেত্রে সততা অবলম্বন করবো ৭) আমি জনসমক্ষে প্রকাশের জন্য কোন সাক্ষাতকার গ্রহণের পূর্বে সাংবাদিক হিসেবে আত্মপরিচয় প্রদান করবো ৮) আমি দায়িত্বপালনকালে পেশাগত নৈতিকতা, সততা ও সম্মানবোধের প্রতি ব্রতী থাকবো ৯) আমি সাংবাদিকদের আচরণবিধি মেনে চলতে বাধ্য থাকবো।
এই শপথের নিচে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের স্বাক্ষর এবং সম্পাদকের স্বাক্ষর থাকে । আমরা অনেকেই এ শপথ পাঠ করি নাই । তবে এ শপথ পাঠ করে তার উপর অবিচল থাকলে সাংবাদিকতার মহান পেশার মহান মানুষের পরিণত হতে পারবো ।
এতে কোন সন্দেহ নেই । সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের কারনে যে সকল মামলা হয়ে থাকে তার মধ্যে মানহানি মামলা অন্যতম । যে কোন ব্যক্তি সর্ম্পকে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ওই ব্যক্তি মানহানি মামলা দায়ের করতে পারেন ।
তথ্য প্রমাণসহ রিপোর্ট করা হলে এ ধরনের মামলায় শেষ পর্যন্ত রিপোর্টারের পক্ষেই রায় আসে । তবে ভুল রিপোর্ট করা হলে সে ক্ষেত্রে খেসারত দেয়া লাগতে পারে । মানাহানি মামলা ফৌজদারী আইনে করা যায় আর সিভিল আইনেও ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা যায় ।
এ সকল মামলায় সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের সাথে সম্পাদক ও প্রকাশককেও আসামী করা হয়ে থাকে। তবে মানহানির মামলায় আদালতের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ আসামীকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আর আদালতও সমন দেয়া ছাড়া প্রথমেই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারবে না ।
আইনের বিধান অনুসারে কোনো মানুষ উদ্দেশ্য মুলকভাবে যদি কোনো কথা, প্রতিক বা দৃশ্যমান কোনো কিছু তৈরি করে বা প্রকাশ করে অপর মানুষের মানহানি ঘটান তবে তা মানহানি হিসেবে বিবেচিত হবে । এছাড়া যদি কোনো মৃত মানুষের বিষয়ে মানহানিকর কোন কিছু বললে বা প্রকাশ করলেও তা মানহানির অপরাধ হবে। এমনকি কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে মানহানিকর কিছু বললে বা প্রকাশ করলেও তা মানহানির অপরাধের পর্যায় পড়বে।
তবে মানহানিকর তখনি হবে যখন বক্তব্যটি বা প্রকাশনাটি সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে নৈতিক ভাবে হেয় করে বা তার চরিত্রকে নিচু করে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রিপোর্টের কারনে আদালত অবমাননার মামলাও হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আদালত অবমাননার জন্য সবচেয়ে বেশী শাস্তি পেয়েছে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা।
একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আদালত অবমাননার অভিযোগে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে ৬ মাসের সর্বোচ্চ সাজা ভোগ করেছেন। আর সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার অলিউল্লাহ নোমান ১ মাসের সাজা ভোগ করেছেন।
সুতরাং রিপোর্ট করার সময় এমন কোন বিষয় রিপোর্টে প্রবেশ করানো উচিত হবে না, যা আদালত অবমাননা হতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
অন্যথায় যে কোন সময় শুধুমাত্র পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সম্পাদক-প্রকাশককে নিয়ে মামলায় জড়িয়ে যেতে হবে । অবশ্য রিপোর্টারগন মামলা ও জেল জুলুমের ভয় করে না । মামলা ও জেল – জুলুমের চেয়ে বড় বিষয় হলো, আমার রিপোর্টের কারণে যাতে কোন নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি না হয় ।
কেননা মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হলো গণমাধ্যম। যখন আইন-আদালতসহ দেশের কোথাও কোন প্রতিকার না পায় তখন মানুষ চেয়ে থাকে গণমাধ্যমের দিকে। ছুটে আসে সাংবাদিকের কাছে। মানুষের এই ভালোবাসা ও বিশ্বাস যেন আমরা চিরকাল অক্ষুন্ন রাখতে পারি সে প্রত্যয়ই আমাদের থাকা উচিত ।