—ছবি লেখকের সৌজন্যে
১. দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দে যমুনা নদীর তীরে দিল্লীর পঞ্চম শহর ফিরোজাবাদের পত্তন করেন। ফিরোজাবাদ শহরে তিনি তার কোটলা বা দুর্গ প্রাসাদ নির্মাণ করেন যা ফিরোজ শাহ কোটলা নামে সমধিক পরিচিত।
প্রাচীর ঘেরা এই স্থাপত্যের একদিকে জামি মসজিদের ছাদবিহীন ধ্বংসস্তুপ বর্তমান। অতীতে এটি দিল্লীর সবচেয়ে বড় মসজিদ ছিল। তুঘলকবাদ ফোর্ট থেকে তুঘলক রাজবংশের রাজধানী ফিরোজাবাদে স্থানান্তর করার অন্যতম কারণ ছিল পানি সংকট।
২. ফিরোজ শাহ কোটলা বর্তমানে একদম ধংসের প্রান্তে। এখানে পর্যটক খুব কম যাতায়াত করে। আমি কোটলায় ঢুকে ভাংগা অংশ দেখতেই নিরাপত্তারক্ষীদের একজন বললেন, ভেতরে আরও দেখার বাকী রয়েছে। সামনে এগুতেই বামদিকে লম্বা লোহার পিলারের মতো দেখতে পেলাম। বুঝতে বাকী রইলো না এটা সম্রাট অশোকের স্তম্ভ! ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৫৬ সালে স্তম্ভটিকে পাঞ্জাবের আম্বালা থেকে আনিয়ে কোটলাতে পুনর্স্থাপনা করেন। এই স্তম্ভের উৎকীর্ণ লিপি থেকে জেমস প্রিন্সেপ ১৮৩৭ সালে ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করেন।
৩. ডানদিকে বেশ ভাংগা বিল্ডিং। আবার, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। আমি নীচ তলায় দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, সেখানে ওযুখানার মতো লাগছে। নীচতলায় ধংস হওয়া বিল্ডিং এর অংশ বিশেষ দেখে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। একটা দরজা দিয়ে ভেতর ঢুকে দেখলাম পুরো উন্মুক্ত ভাংগা ছাদ। তবে সেখানে যাবার আগে সবাই জুতা খুলে প্রবেশ করছে। কয়েকজন মহিলাকে সেখানে যেতে দেখলাম। মনে হল উপরের অংশে কেউ বসবাস করছে।
আমি যখন প্রথমবার দেখি, তখন বুঝে উঠতে পারিনি এটা জামি মসজিদ হতে পারে। কিছুক্ষণ পরে লক্ষ্য করলাম যে, কিছু মুসলিম নামাজ আদায় করছিলেন। মহিলাদের জন্য ছিল আলাদা জামাতের ব্যবস্থা। নামাজরত অবস্থায় না দেখলে বোঝা মুস্কিল ছিল যে, এটা মসজিদ ছিল! আমি যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম, সেটাই ছিল ফিরোজাবাদ কোটলা মসজিদের প্রবেশ দুয়ার।
৪. মসজিদ বলতে আমরা যা বুঝি, মসজিদের তেমন কিছুই ছিল না। ছাদবিহীন মসজিদ শুধু প্রথম সারিতে জায়নামাজ পাতানো। তবে, বোঝা যায় দোতলার ছাদ পুরোটাই মসজিদ ছিল। কিন্তু, বৃষ্টি হলেই এখন দাঁড়ানোর ব্যবস্থা নেই। নীচতলার বিল্ডিং ঠিক থাকলেও, সেখানে কি ছিল সেখানে তা' আজকের প্রেক্ষিতে বোঝা যায় না। ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লী আক্রমণকারী তৈমুর লং এই মসজিদে প্রতি শুক্রবার নামাজ পড়তে আসতেন। তিনি মসজিদ দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সমরখন্দে ততকালীন সময়ে একই রকম একটা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। আমিও এই মসজিদে নামাজ আদায় করেছি।
মসজিদে একটা ইমাম রয়েছেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানালেন, এই মসজিদে এখনো নিয়মিত জুম্মার নামাজ আদায় করা হয়। সকাল ও সন্ধ্যায় কোটলা বন্ধ থাকায় নামাজ আদায় করা সম্ভব না হলেও দর্শনার্থীরা এলে অন্যান্য সময়ের নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। এই মসজিদের তৈরি আমল থেকে কখনো নামাজ আদায় বন্ধ হয়নি। প্রশাসন ও দর্শনার্থীরা চাইলে তারাবির নামাজও আদায় করা হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতে এখনো এখানে এক হাজারের বেশি মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
৫. এমন এক ঐতিহাসিক মসজিদে কে নামাজ পড়তে না চায়? তবে সাধারণ মানুষের নামাজ পড়তে আসার বাধা হল টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। পর্যটক ছাড়া যারা নামাজ পড়তে আসেন তারাও নির্ধারিত ৩০ রূপির টিকেট কেটেই আসেন বলে নিশ্চিত হয়েছি। বাইরে আরও মসজিদ রয়েছে। তবুও এই মসজিদে আসার কারণ, সম্ভবত মসজিদটি দিল্লির অন্যতম পুরাতন অথবা, এর মনোস্তাত্ত্বিক মূল্য রয়েছে। আমি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।
এত পুরাতন মসজিদ, যেখানে ছাদ পর্যন্ত নেই! বৃষ্টি বা রোদে মুসল্লিরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যাবেন। তবুও এই মসজিদেই নামাজ আদায় করতে আসছেন! মানুষের ভেতরে একটা মিথ নিশ্চয়ই কাজ করে।
৬. সাধারণ মানুষের বিশ্বাস কোটলার মসজিদে প্রতি বৃহস্পতিবার জ্বীন জাতি নামাজ পড়তে আসে। সেদিন এখানে মানুষের জমায়েত বেশি হয়। তারা মনের বিভিন্ন ইচ্ছাপূরণের জন্য কাগজে চাহিদাপত্র লিখে নিয়ে আসেন।
তাঁদের বিশ্বাস, এ ভাবেই জেনে নিয়ে অশরীরীরা তাঁদের মনের বাসনা পূর্ণ করবেন। ঘটনার সূত্রপাত ১৯৭৭ সালে। সেই সময় লাড্ডু শাহ নামের একজন সাধু ফিরোজ শাহ কোটলাতে অবস্থান করতে শুরু করেন। তখন হঠাৎই রটে যায়, ফিরোজ শাহ কোটলা নাকি অশরীরীদের আস্তানা। রটনা থেকে কালক্রমে সেটা সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে পরিণত হয়।
অনেকেই মনে করেন, এটা মানুষের নিছক ভাবনা। অনেকেই ভাবছেন, জ্বীন জাতিকে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ স্বীকৃতি দিয়েছে। সেবাগ্রহীতারা অনেকেই ফলাফল পেয়েছেন বিধায় সন্তুষ্ট হয়ে আবার আসছেন বলেও কেউ কেউ মনে করেন। আমি নিজেও কিছু কাগজ পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখেছি, তবে অন্য ভাষায় বিধায় বুঝিনি।
৭. দিল্লি সালতানাতের আমলে ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে নির্মিত এই মসজিদে নেই কোন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। আসলে মসজিদটি এমন অবস্থায় রয়েছে যে, তার মেহরাব, মিনার, খিলানের বর্ণনা দেয়া কঠিন। তবে কোটলার ধ্বংসপ্রায় দালানের অংশ বিশেষ দেখে এর স্থাপত্যরীতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে। বর্তমানে মসজিদের কোন মিনার অবশিষ্ট না থাকলেও ধ্বংসপ্রায় মেহরাব বিদ্যমান। মেঝেতে কোয়ার্টজ পাথরের উপরে চুনের প্রলেপ লক্ষ্য করলাম। এছাড়াও ছাদ না থাকলেও তিনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেয়াল রয়েছে।
মসজিদ ও কোটলার বিভিন্ন ধ্বংসপ্রায় অংশ দেখে ধারণা করা যেতেই পারে , দিল্লি সালতানাতের তুঘলক স্থাপত্যরীতিতে কোটলা নির্মিত হয়েছে। এর গ্রানাইড পাথর, চুন, সুরকি তুঘলকবাদ ফোর্ট ও হাউস খাসের বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসাবশেষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মসজিদে ঢোকার সংস্কারহীন প্রধান ফটক এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও তা' অবহেলিত বোঝা যায়। ফটকটিতে কয়েকটি খিলান ও ধ্বংসপ্রায় গম্বুজ অবশিষ্ট রয়েছে। যা ইসলামি স্থাপত্য চিহ্ন বহন করছে।
৮. তুঘলক শাসকদের অধীনে স্থাপত্যবিভাগ ও নির্মাণ বিভাগ আলাদা ছিল। তুঘলক সাম্রাজ্যের তৃতীয় সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনকাল ১৩৫১-১৩৮৮) বহু ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর সময়ে নির্মিত ইমারতগুলোর স্থাপত্যকলার বৈশিষ্ট্যগুলো ইসলামি স্থাপত্যকলায় দেখা যায় অথবা ইসলামি স্থাপত্যকলার বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদাও হতে পারে। এই সময়ে ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যে ভারতীয় স্থাপত্যের কিছু উপাদান যুক্ত হয়। যেমন, উঁচু স্তম্ভমূলের ব্যবহার, ইমারতের কোণা ছাড়াও স্তম্ভ; স্তম্ভের উপরে এবং ছাদে ঢালাইয়ের ব্যবহার।
৯. মসজিদে ঢোকার আগে বামপাশে একটা বড় বাউলি রয়েছে। যার বয়স মসজিদের জন্মের সময়ের বা দূর্গের পত্তনের সময়ের হবে। বাউলিতে পানি উত্তোলন আপাতত বন্ধ রয়েছে, সেখানে সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। সেই সময় বাউলি কোটলার বাসিন্দাদের পানির চাহিদা পূর্ণ করতো। বাউলিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।
১০. ফিরোজ শাহ কোটলার আশে পাশে এলাকায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। ফিরোজ শাহ কোটলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম ( অরুণ জেটলি ক্রিকেট স্টেডিয়াম), আইটিও, রাজঘাট, পুতুল জাদুঘর, দিল্লি গেট, সুপ্রিম কোর্টসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে। দিল্লি মেট্রোতে গেলে দিল্লিগেট মেট্রোস্টেশনের কাছেই কোটলার গেট।
কোটলা মসজিদের ছাদ পুনরায় নির্মাণ করে দিলে যেমন ইসলামি ঐতিহ্য সমুন্নত থাকতো, তেমনি মুসলিম সম্রদায়ের মানুষ নামাজ আদায় করতে পারতেন। একটা পুরাকীর্তি নতুনভাবে দর্শনার্থীরা দেখার সুযোগ পেতেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে সাড়ে ছয়শত বছরের বেশি সময় ধরে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হচ্ছে খুবই কম মসজিদে। ফিরোজ শাহ কোটলাতে অযত্নের প্রচ্ছন্ন ছাপ লক্ষ্যণীয়। মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণে আরকিওলজিকাল সার্ভে অব দিল্লির আরও সচেতন হওয়ার দরকার।
লেখক: ব্যাংকার ও গল্পকার।